নির্বাক: আপাতত থেমে এই যন্ত্রের ব্যস্ততা। ফাইল চিত্র
প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে এমনিতেই মন্দা এসেছে ঘরোয়া তাঁতশিল্পে। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার অন্যতম এই ঐতিহ্য। বাজারে বৈদ্যুতিক যন্ত্রচালিত তাঁতমেশিন আসায় পুরনো তাঁতঘরের পন্যের চাহিদাও দিন দিন কমেছে। এই সব তাঁতঘরে তাঁতের কাপড়, গামছা, গজ-ব্যান্ডেজ— সব কিছুই তৈরি হত। কিন্তু সব কিছুতেই এসেছে মন্দা।
এরই মধ্যে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো তাঁতশিল্পের ঘাড়ে চেপে বসেছে করোনাভাইরাস আতঙ্ক। লকডাউনে হাট-বাজার, দোকানপাট সব বন্ধ থাকায় বড় রকম সঙ্কটের মুখে পড়েছেন কয়েক হাজার তাঁতি। এর ফলে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমেও আগামী দিনে গজ-ব্যান্ডেজের জন্য হাহাকার দেখা দিতে পারে।
বসিরহাটের অন্যতম কুটির শিল্প হল তাঁত। সেই তাঁতের উৎপাদিত দ্রব্য হল গজ ও ব্যান্ডেজ। বসিরহাটে তৈরি গজ ও ব্যান্ডেজ রাজ্যের প্রায় সব হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমেই যায়। অসম, বিহার এবং ওড়িশাতেও বসিরহাটে উৎপাদিত গজ ও ব্যান্ডেজ সরবরাহ করা হয়। এই পেশার সঙ্গে সরাসরি কয়েক হাজার শ্রমিক জড়িত। জড়িত মহিলারাও। লকডাউনের কারণে সুতো আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সব তাঁত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁত বন্ধের কারণে সমবায় সমিতিগুলি শ্রমিকের অভাবে বন্ধ।
২০১১ সালে তাঁতশ্রমিকদের একত্রিত করতে বসিরহাট মহকুমা তন্তজীবী ও তাঁত শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। ওই ইউনিয়নের সভাপতি কৌশিক দত্ত বলেন, ‘‘বর্তমানে বসিরহাট মহকুমা জুড়ে ২১টি তন্ত সমিতি রয়েছে। এগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন অন্তত পঁচিশ হাজার কর্মী। শুরু থেকেই এই সমিতিতে গজ-ব্যান্ডেজে উৎপাদনের কাজই করতেন তাঁরা। কিন্তু এখন তাঁরা বেকার। আর্থিক ভাবে চরম বিপদের মুখে পড়েছেন।’’
বসিরহাটের দেভোগ, শশিনা, ইটিন্ডা সীমান্তবর্তী পানিতর, কঠুর, তিন নম্বর কলোনি, ফুলবাড়ি, শ্রীরামপুর-সহ একাধিক জায়গায় এক সময় দিন-রাত তাঁতের খটখটানি শোনা যেত। এখন সেই শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। তাঁতশিল্পের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়েছে।
বসিরহাটের দেভোগ গ্রামে বাড়ি ফকির আহমেদ, জিয়ারুল দফাদার, রাধ্যশ্যাম দাসের। এঁরা সকলেই তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। রাধেশ্যাম বলেন, ‘‘তাঁতশিল্পের জন্য মূলত কেরল, তামিলনাড়ু থেকেই সুতো আসে। এখন সেসব মিলছে না। বড় রকম সঙ্কটের মুখে পড়েছেন তাঁতিরা। গজ-ব্যান্ডেজ তৈরিতেও নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর উপর আবার লকডাউনের কারণে প্রায় সব কাজ বন্ধ হওয়ায় এই পেশার কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বিপদগ্রস্ত।’’
তাঁতশিল্পী আকবর মোল্লা বলেন, ‘‘মেশিনের তৈরি কাপড়ের সঙ্গে চিরাচরিত হস্তচালিত তাঁত টিকে থাকতে পারছে না। কর্মীদের রোজগার কমেছে। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।’’ কুতুবুদ্দিন গাজি বলেন, ‘‘এখন হাতে তৈরি তাঁতের কাপড়ের বিক্রি এমনিতেই কম। এর উপরে মেশিনের তৈরি কাপড়ের নিত্য নতুন নকশা এবং রঙের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারে টিকে থাকাও তার পক্ষে বেশ শক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে আমাদের তৈরি কাপড়ের বিক্রি কমে গিয়েছে। আমাদের রোজগারও কমে যাচ্ছে। এক সময়ে যেখানে ১২০ জন তাঁতি তাঁত বুনতেন, এখন সেখানে মাত্র ১৫ জন কাজ করছেন। লকডাউনের সঙ্কটে সেই পনেরোজনও কাজ করতে পারছেন না। তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের পেটে টান পড়েছে।’’