স্মৃতি: সেই বাড়িতে একাকী ব্রততীদেবী। ছবি: মাসুম আখতার।
তেতলা বাড়ির একতলার দরজায় এখনও তাঁর নাম লেখা বোর্ড ঝুলছে। ওই একতলার দু’টি ঘরের একটিতেই চলত তাঁর ডাক্তারখানা। আর তার পাশের একফালি ঘরটি ছিল রোগীর ভিড় সামলে তাঁর একটু জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা। কোভিডের হানায় গত বছর মারা গিয়েছেন তিনি। তবু তাঁর বাড়িতে আজও পুরনো রোগীদের কেউ কেউ ভিড় জমান। চিকিৎসা ছাড়াও ডাক্তারবাবুর থেকে অন্য ভাবে সাহায্য পাওয়া মানুষজন আজও তাঁর শ্যামনগরের বটতলার বাড়িতে এসে আফসোস করেন।
মোটরবাইকে চেপে কল্যাণী হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকে ফিডার রোডে উঠে এক পেয়ারা বিক্রেতার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রদীপ ভট্টাচার্যের ঠিকানা। আফসোসের সুরে তাঁর জবাব, ‘‘করোনা মেরে ফেলল ডাক্তারবাবুকে। আমাদের মতো গরিব মানুষের থেকে ফি নিতেন না। কত লোককে যে কত উপকার করেছেন।’’
করোনার মরসুমে শ্যামনগরের বাসিন্দা, চিকিৎসক প্রদীপ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ঘটনা অনেকেরই মনে আছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য প্রদীপবাবু ভর্তি হয়েছিলেন ইস্টার্ন বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ৩০ লক্ষ টাকা চিকিৎসার বিল ধরানো হয়েছিল ডাক্তারবাবুর পরিবারকে। গত বছর ১০ অগস্ট প্রদীপবাবুর মৃত্যু হয়। বিপুল অঙ্কের বিলের টাকা মিটিয়ে হাসপাতাল থেকে তাঁর দেহ ছাড়াতে সে সময়ে প্রদীপবাবুর পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা ছাড়াও পাড়ার ক্লাব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই।
লকডাউনের বর্ষপূর্তির আগে প্রদীপবাবুর বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেল, তাঁর বাড়ির নীচে সেই ডাক্তারখানা বন্ধ। তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার একচিলতে ঘরটি এখন জিনিসপত্রে ঠাসা। প্রদীপবাবুর স্ত্রী ব্রততীদেবী জানালেন, ওই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। শীঘ্রই তাঁরা অন্যত্র উঠে যাবেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান ঋতম্ভর আজও বাবার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। তাই সে-ও চায়, এই বাড়ি বিক্রি হয়ে যাক।
ব্রততীদেবীর কথায়, ‘‘ওঁর চলে যাওয়ার পরে কয়েকটা মাস শুধুই কান্নাকাটি করে কেটেছে। উনি আমার মাথার উপরে ছায়ার মতো ছিলেন। কোনও কাজ আমাকে করতে দিতেন না। এখন আমার জীবনযাত্রাও সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। এখন সবটাই আমাকে করতে হয়। উনি চাইতেন ছেলে ডাক্তার হবে। ওঁর সেই ইচ্ছে পূরণ করার গুরুদায়িত্ব এখন আমার উপরে। আমিও চাকরি খুঁজছি। চলতে তো হবে।’’
জ্বর আসায় গত বছর ১৫ জুলাই ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রদীপবাবু। সে দিনই স্ত্রীর সঙ্গে হাসপাতাল থেকে ফোনে কথা হয়েছিল তাঁর। সেই শেষ কথা। ২১ জুলাই জানা যায়, ব্রততীদেবীও সংক্রমিত। তিনি ভর্তি হন একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। এর পরে ১০ অগস্ট প্রদীপবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ বিশেষ অনুমতি নিয়ে পাড়ার ক্লাবের উদ্যোগে নিয়ে আসা হয় বটতলায়। সে দিন কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারবাবুর মরদেহের পিছনে শোক মিছিল করে স্বেচ্ছায় হেঁটেছিলেন প্রচুর মানুষ। কিন্তু সে দিন স্বামীকে শেষ দেখা দেখার মতো মানসিক জোর ছিল না ব্রততীদেবীর। তিনি বলছেন, ‘‘আমি সুস্থ হয়ে ফিরে এলাম। জানি না কেন উনি ওই হাসপাতালে গেলেন। ওই দিনই আমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল।’’
কিন্তু যে বাড়িতে, যে পাড়ায় ডাক্তারবাবুর এত স্মৃতি, সেখান থেকে চলে যাবেন?
ব্রততীদেবীর জবাব, ‘‘পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে তো হবেই। ওঁর স্মৃতিতে বাড়ির কাছেই একটা ক্লিনিক চালু করেছি। ডাক্তারবাবুর পুরনো রোগীরাই সেখানে আসেন।’’
বাড়ি বিক্রির কারণ ব্রততীদেবী খোলসা না করলেও প্রতিবেশীদের কারও কারও ধারণা, ডাক্তারবাবুর চিকিৎসার বিপুল খরচের ধাক্কায় জর্জরিত তাঁর পরিবারও। তাই হয়তো বাড়ি বিক্রি করেছেন ওঁরা।
শ্যামনগরের বটতলায় এ বার কাহিনী হয়ে থেকে যাবেন প্রদীপ ডাক্তার।