—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
২০২০ সাল। দেশ জুড়ে করোনা আতঙ্কের মধ্যেই বাংলার উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আমপান। কার্যত ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় জনজীবন। বহু ঘর ভাঙে। জলের তলায় চলে যায় বিঘের পর বিঘে চাষের জমি। প্রশাসনের তরফে প্রাথমিক ভাবে ত্রাণ, ত্রিপলের ব্যবস্থা হয়। পরে ক্ষতিপূরণও ঘোষণা হয়। কিন্তু সেই ত্রাণ বিলি নিয়েই সামনে আসে একের পর এক মারাত্মক সব অভিযোগ। অভিযোগ ওঠে, গরিব মানুষের ত্রাণ বিলি নিয়ে দুর্নীতি করেছেন শাসক দলের নেতারাই। চাল-ত্রিপল চুরির অভিযোগ ওঠে। ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাতের একাধিক অভিযোগও উঠেছিল সে সময়ে। শাসক দল অভিযোগ মানেনি বলাইবাহুল্য। অন্যান্য দল যেখানে পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় আছে, সেখানেও উঠেছিল একই অভিযোগ। কোথাও কোথাও প্রধানেরা ঘেরাও হন। বিক্ষোভ হয় পঞ্চায়েতে।
আমপানের পরে গত কয়েক বছরে ফণী, বুলবুল, ইয়াস, রেমালের মতো একের পর এক ঘূর্ণিঝড় এসেছে। কোনও ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি, কোনওটায় কম। প্রশাসনের তরফে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ, ত্রিপল বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু তা বিলি-বণ্টন নিয়ে একই ভাবে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে প্রায় প্রতি বারই। দুর্গতদের বঞ্চিত করে ত্রাণের সামগ্রী খোলাবাজারে পাচার করে এক শ্রেণির নেতা পকেট ভরিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবারও এক ঘূর্ণিঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে সেই ত্রাণ-কেলেঙ্কারিই চিন্তা বাড়াচ্ছে উপকূলের মানুষজনের। প্রকৃতির হাতে সব হারাতে হলে, প্রশাসনের প্রাপ্য সাহায্যটুকু ঠিক মতো হাতে পাবেন কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কায় অনেকেই। গোসাবার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘দুর্যোগ ঘনালেই খুশি হয়ে যান রাজনীতির কারবারিদের অনেকে। বিপদ হলে পরিত্রাণের জন্য আসবে ত্রাণ। আর তা থেকে পকেট ভরবে কারও কারও— এই তো চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে!’’
বিভিন্ন দুর্যোগে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত সন্দেশখালির মণিপুর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা এক ব্যক্তির কথায়, “কোনও বিপর্যয় হলে আমাদের জন্য সরকার যতটা ত্রাণ পাঠায়, ততটা এসে পৌঁছয় না আমাদের কাছে। মাঝপথে বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল নেতারা ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি ও দুর্নীতি করে।” ভাঙড়ের বাসিন্দা এক গৃহবধূ বলেন, “কিছু দিন আগে টানা বৃষ্টির কারণে ঘরে জল পড়ছিল। পঞ্চায়েতে গিয়ে ত্রিপল চেয়েও পাইনি। এর আগে আমপানের সময়েও ক্ষতিপূরণের টাকাও পায়নি। শাসক দল তাদের পছন্দের লোকজনকেই ত্রাণ বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে।”
সুন্দরবনের নদীবাঁধ ও জীবন জীবিকা রক্ষা কমিটির অন্যতম নেতা চন্দন মাইতি বলেন, “আমপান, ইয়াসে আমরা দেখেছি কী ভাবে ত্রাণ লুট হয়েছে। সাধারণ ক্ষতিগ্রস্তেরা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। কিন্তু শাসকদলের নেতারা নিজেদের দলের লোকদের বেছে বেছে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। নিজের কাছের লোকের নামে ক্ষতিপূরণ হাতিয়ে নিয়েছেন। অথচ, দিনের পর দিন বেহাল বাঁধ মেরামতে উদ্যোগই নেয়নি প্রশাসন। এই বাঁধ কংক্রিটের না হলে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা কমবে না। প্রতিটা দুর্যোগেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হবে তাঁদের।”
রায়দিঘির নদীবেষ্টিত গ্রামের বাসিন্দা তথা সিপিএম নেতা ইয়াসিন গাজি বলেন, “দুর্যোগ হলেই শাসক দলের নেতাদের মনে খুশি খুশি ভাব দেখা দেয়। গরিব মানুষের ঘরবাড়ি, পুকুর, খাল ভেসে যাবে, আর ক্ষতিপূরণ পাবেন দোতলা, তিনতলা বাড়ির মালিক শাসক দলের ছোট, বড়, মাঝারি নেতারা!”
আরএসপি নেতা তথা বাম আমলের দীর্ঘ দিনের সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্করের কথায়, “আমপান, ইয়াসে আমরা দেখেছি, কী ভাবে দুর্নীতি হয়েছে। ঝড়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি। শাসক দলের নেতারা নিজের নামে, পরিবারের সদস্যদের নামে সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছেন। দুর্যোগে যখন সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, তখনই এই ধরনের ধান্দাবাজেরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য।”
তবে গদিতে থাকাকালীন বামেদের বিরুদ্ধেও ত্রাণ বিলি, বাঁধ তৈরির টাকা নিয়ে অভিযোগ উঠত ভুরি ভুরি। সে সময়ে বিরোধী দলের নেতানেত্রীরা তা নিয়ে বিস্তর গলা ফাটাতেন। এ নিয়ে কী বলছেন সুভাষ? তাঁর সাফাই, ‘‘ছোটখাট ভুলভ্রান্তি হত না, এ কথা বলছি না। কিন্তু এখন দুর্যোগের পরে দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে।’’
শাসক দলের নেতারা অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগ মানতে নারাজ। তৃণমূলের রায়দিঘির বিধায়ক অলোক জলদাতা বলেন, “ত্রাণ বিলি নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক নয়। সরকারি পদ্ধতিতে ত্রাণ বিলি করা হয়। পঞ্চায়েত স্তরে তো বিরোধী সদস্যেরাও আছেন। তাঁরাও ত্রাণ বিলিতে অংশ নেন।” সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতো বলেন, “কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে বিরোধীদের তো এলাকায় দেখা যায় না। তৃণমূল কাজ করে মানুষের জন্য। যাঁরা কাজ করে, তাঁদের কিছু ভুল হয়। কিছু দুর্নামও ছড়ায়।”