প্রত্যাবর্তন যদি লক্ষ্য হয়, তবে নিউ ব্যারাকপুরের পুরভোটে পরিবর্তনই ‘ইস্যু’ সব পক্ষের।
এই পুরসভার এক পাশে কলকাতা সংলগ্ন দমদম, অন্য পাশে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসত ও মধ্যমগ্রাম পুরসভা। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই প্রোমোটার-রাজ আর ফ্ল্যাট ‘কালচারে’ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ওই পুরসভাগুলির মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল নিউ ব্যারাকপুর। পুকুরের পাড়ে অন্তত দু’তিন কাঠার বাড়ি, খোলা আড্ডা, পাড়া-সংস্কৃতি ছিল তার বৈশিষ্ট্য।
সেই সংস্কৃতি বদলে গিয়েছে নিউ ব্যারাকপুরেও। ঘোলা থানার অর্ন্তবর্তী ফাঁড়ির তকমা ছেড়ে নিজস্ব থানার পরিচয় মিলেছে। পাঁচ বছরে ৮-১০ ফুটের রাস্তা চওড়া হয়ে এখন ১২-১৪ ফুট। তার সমানুপাতিক হারে উঁচু হয়েছে বহুতল। এলাকা সাফ-সুতরো। ফ্ল্যাটের সঙ্গে একদা মফস্সল এই শহরের অন্দরে ঢুকে পড়েছে প্রোমোটার-রাজ।
টানা ৪৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে গত পুরভোটে ১৯টির মধ্যে ৮টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বামেরাই। কিন্তু ৬টি আসন নিয়ে তৃণমূল ও ৫টি নিয়ে কংগ্রেস মিলে পুর-বোর্ড গঠন করে। চেয়ারপার্সন হন তৃণমূলের নির্মিকা বাগচী, ভাইস চেয়ারম্যান কংগ্রেসের মনোজ নিয়োগী। ২০১৩ সালে মনোজবাবুর নেতৃত্বে চার কংগ্রেস কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দিলে একক ভাবে পুর-বোর্ডের দায়িত্ব নেয় তৃণমূল।
এ বারের লড়াই সেই পরিবর্তনের অবস্থান থেকেই। মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় নিজের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছেড়ে ১ নম্বরে প্রার্থী হয়েছেন মনোজবাবু। ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী হলেন পূর্ণিমা রায়। তিনিই বিগত বোর্ডের সময় থেকে কংগ্রেসে রয়ে যাওয়া একমাত্র কাউন্সিলর, যাঁকে ৯৫ সাল থেকে নিজেদের ‘সুসময়েও’ হারাতে পারেনি বামেরা। ঠিক সে ভাবেই ২ নম্বর ওয়ার্ডে এলাকার বধূ মৌমিতা রাহা দাস এবং ৩ নম্বরে মনোজবাবুদের একদা ‘ডান হাত’ অভিজিৎ বিশ্বাস কংগ্রেসের হয়ে লড়ছেন। গত পুরভোটে জিতেও তৃণমূলে চলে যাওয়া এই দু’টি ওয়ার্ড ছাড়াও ১৯ নম্বরের মতো ওয়ার্ডে বাম বা বিজেপি প্রার্থী না থাকায় লড়াই দেবে কংগ্রেস।
১ থেকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল ও কংগ্রেসের লড়াইয়ে আখেরে তাদেরই লাভ হবে, দাবি বামেদের। এ ছাড়াও ১৪ নম্বরে কুন্তলা সাহা, ৬ নম্বরে সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, ৮ নম্বরে প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৬ নম্বরে সুনীত ঘোষের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বামেরা। ২টি আসনে প্রার্থী দিতে না পারলেও সিপিএম নেতা ত্রিদিব ঘোষের দাবি, ‘‘ঠিকমতো ভোট হলে ফল অন্য রকম হবে।’’ আর উন্নয়নের প্রশ্নে ত্রিদিববাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কীসের উন্নয়ন? রাস্তা আমরাই করেছিলাম, শুধু চওড়া হয়েছে। মাতৃসদন করেছিলাম, তাতে কিছু উন্নতি হয়েছে। নতুন কী হয়েছে?’’
বিধায়ক তথা রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘জলকর তুলে দেওয়া, নতুন থানা, মাতৃসদনের উন্নতি, রেশন ব্যবস্থা, নদর্মা-খাল সংস্কার— প্রচুর কাজ হয়েছে।’’ পরিবর্তন তেমন কিছুই হয়নি, সমস্যা রয়েছে অনেক—এমন দাবি তুলে ১৮ নম্বরের বিজেপি প্রার্থী অ়ঞ্জনা সরকার বলেন, ‘‘কলকাতা পুরসভার ভোটে তাণ্ডব না হলে তৃণমূলের বিপদ আছে।’’
ভোটে জিতে ফের যাতে চেয়ারপার্সন হতে না পারেন, সে জন্য নির্মিকাদেবীর বিরুদ্ধেই গোঁজ দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ‘‘এ সব কোনও বিপদ-ই নয়,’’ জানিয়ে নিউ ব্যারাকপুরের তৃণমূল সভাপতি সুখেন মজুমদার বলেন, ‘‘চেয়ারম্যান কে হবেন, ভোটের পরে দলই তা ঠিক করবে।’’ সুখেনবাবুর স্ত্রী তৃপ্তি মজুমদার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এবং ভাই সৌমিত্র (কালু) মজুমদার ১২ নম্বরে প্রার্থী হয়েছেন।
‘ভাই না বৌ’ প্রশ্ন করলে মহাভারতের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনেন সুখেনবাবু। অহংঙ্কারকে বিনাশ করে সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজের আত্মীয়কে বধ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছিলেন, তা বলতে থাকেন। বাধা দিয়ে সৌমিত্রবাবু বলেন, ‘‘ভুল বলছ দাদা, শ্রীকৃষ্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের কথা বলেছিলেন।’’
সত্য না ধর্ম, কোন লক্ষ্যে এ যুদ্ধ— সেটাই এখন দেখার।