তল্লাশি: ঘটনাস্থলে পুলিশ কুকুর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
ছেলে জানতেন, মা ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। বুধবার ভোর রাতে গ্রামের পাটকাঠির গাদায় যখন আগুন লেগেছিল, গ্রামের মানুষের সঙ্গে তিনি-ও ছুটে গিয়েছিলেন জল ঢেলে আগুন নেভাতে। আগুন নেভার পরে পাটকাঠির গাদায় এক যুবক ও মহিলার অগ্নিদগ্ধ দেহ দেখতে পান সবাই। দেহদু’টি কার তা বোঝা যাচ্ছিল না। খটকা লাগায় দৌড়ে বাড়ি এসে দেখেন, মা ঘরে নেই। আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে মায়ের খোঁজ শুরু করেন ওই যুবক। পরে শনাক্ত হয়, আগুনে পুড়ে যাওয়া মহিলাটিই তাঁর মা।
ঘটনাটি ঘটেছে বনগাঁর শিবপুর গ্রামে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম তপতী মণ্ডল (৪৬) এবং প্রসেনজিৎ বৈদ্য ওরফে বলাই (২৫)। পুলিশ দেহ দুটি উদ্ধার করে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য। পরে অবশ্য দেহদু’টি ময়নাতদন্তের জন্য কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ কর্তাদের মনে হচ্ছে, ওই যুবক এবং মহিলাকে মেরে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আপাতত অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘দুজনকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
কী কারণে তাঁদের খুন করা হয়ে থাকতে পারে? তদন্তকারী অফিসারদের বক্তব্য, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে ওই ঘটনা। মহিলার সঙ্গে অতীতে অনেকের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। পুরনো আক্রোশ থেকেই কেউ এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শিবপুর গ্রামের যুবক বলাই কেরলে কাজ করতেন। এ বার দুর্গাপুজোর সময় বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর থেকে তিনি আর কেরলে ফেরেননি। এখানে খেতমজুরি ও দিনমজুরির কাজ করতেন। তপতীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে গাঁয়ের মানুষের মধ্যে গুঞ্জন দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। দুজনকে মাঠে-খেতে গোপনে মেলামেশা করতে দেখা যেত।
বুধবার ভোর ৩টে নাগাদ শিবপুর গ্রামে ইছামতী নদীর কাছে পাটকাঠির গাদায় আগুন জ্বলতে দেখে ছিলেন কয়েকজন গ্রামবাসী। তাঁদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় পাড়া প্রতিবেশীদের। ঘর থেকে বেরিয়ে মহিলা পুরুষেরা ছুটে আসেন। হাতের কাছে যে যা পেয়েছিলেন, তাতে জল নিয়ে এসে তাঁরা আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করেন। চালানো হয় মোটর- পাম্পও। এলাকার বাসিন্দা রমেশ মণ্ডল বলেন, ‘‘আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। জল ঢেলেও আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। পরে বনগাঁ থেকে দমকলের একটি ইঞ্জিন এসে আগুন নেভায়। আগুন নিভে আসতেই দেখা যায় এক যুবক ও মহিলার দগ্ধ দেহ পড়ে রয়েছে।’’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুন নেভানোর সময় তাঁরা কোনও চিৎকার শোনেননি। সম্ভবত ওঁদের আগে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, দেহ দুটি শনাক্ত করা হয়। কেন পুলিশের মনে হচ্ছে এটা খুনের ঘটনা? তদন্তকারী এক অফিসার বলেন, ‘‘তিনটি করে ইটের উপর বাঁশের মাচা করে পাটকাঠির স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। দেহদু’টি ছিল, ইট ও বাঁশের মধ্যে সামান্য ফাঁকা জায়গার মধ্যে। সেখানে দু’জনের ঢোকা সম্ভব ছিল না। তাঁদের মেরেই সম্ভবত দেহদুটি সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দুপুরে প্রশিক্ষিত কুকুর আনা হয়। কুকুরটি বিএসএফ এর ১০৭ নম্বর ব্যাটলিয়নের। কুকুরটি মৃতদের পোড়া কাপড় শুঁকে দৌড়ে মনিগ্রামের দিকে চলে যায়। সেখানের একটি দোতলা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। বাড়ির ছাদে ঘুরে নেমে আসে। অন্য একটি বাড়ির মধ্যেও যায় কুকুরটি। এরপর মৃত যুবকের বাড়ির কাছে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, কুকুরের গতিবিধি ধরে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদেরও খবর দেওয়া হয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবার তাঁদের ঘটনাস্থলে আসার কথা।
এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, পোড়া পাটকাঠির গাদাটি দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মৃত বলাই এর মা সবিতা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বলাই এর দাদা রঞ্জিত বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাত আটটা নাগাদ ভাইয়ের মোবাইলে ফোন এসেছিল। ভাত খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। তারপরে যে ও বেরিয়েছিল, তা আমরা জানতে পারিনি। ওই মহিলার সঙ্গে ভাই মোবাইলে কথা বলত জানতাম। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাইয়ের মোবাইল, জামা-প্যান্ট বাড়ির কাছেই একটি গাছে ঝোলানো ছিল।’’ তপতীর ছেলেও জানিয়েছেন, ‘‘রাতে সাড়ে ৯টা নাগাদ মা ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। কখন বেরিয়েছে, জানতে পারিনি। আগুন নিভিয়ে ঘরে ফিরে দেখি মা ঘরে নেই। তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।’’