আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও মিলছে না ক্ষতিপূরণ

মোমিনা ও আমিরুন বলেন, ‘‘আজও সরকারি সাহায্য পাইনি। আমাদের স্বামীরাই ছিলেন সংসারের একমাত্র রোজগেরে। এমনিতেই তাঁদের চিকিৎসার খরচ সামলাতে গিয়ে বাজারে অনেক ধার দেনা হয়ে গিয়েছে। এখন সেই ঋণ শোধ করব না সংসার খরচ চালাব, বুঝতে পারছি না।’’

Advertisement

সামসুল হুদা

ভাঙড় শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৯ ০২:৫৩
Share:

অসুস্থ: সিলিকোসিসে আক্রান্ত কারিমুল্লা মোল্লা। মিনাখাঁর গোয়ালদহ গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

মোমেনা বিবি এখন শাড়িতে জরির কাজ করে সংসার চালান। কোনও রকমে তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ের খাবার জোগাড় করেন তিনি। ২০১৬ সালে মোমিনার স্বামী সফির আলি পাইক সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় চার বছর, কিন্তু এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি মোমিনা।

Advertisement

ওই বছরই মারা গিয়েছিলেন নজিম আলি মোল্লা। তাঁর পরিবারও সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তাঁর স্ত্রী আমিরুন বিবি দুই ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে আধপেটা খেয়ে বেঁচে আছেন। টাকার অভাবে তাঁর দুই ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দর্জির দোকানে সেলাইয়ের কাজ করছেন।

মোমিনা ও আমিরুন বলেন, ‘‘আজও সরকারি সাহায্য পাইনি। আমাদের স্বামীরাই ছিলেন সংসারের একমাত্র রোজগেরে। এমনিতেই তাঁদের চিকিৎসার খরচ সামলাতে গিয়ে বাজারে অনেক ধার দেনা হয়ে গিয়েছে। এখন সেই ঋণ শোধ করব না সংসার খরচ চালাব, বুঝতে পারছি না।’’

Advertisement

গত বছর ৩ অক্টোবর কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় হরিয়ানা মডেলে সিলিকোসিসে মৃতের পরিবারগুলিকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আক্রান্ত ও মৃতের পরিবারগুলিকে পেনশনের ব্যবস্থা এবং তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা ও মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। অভিযোগ, হাইকোর্টের সেই নির্দেশ এখনও কার্যকর করা হয়নি।

এ দিকে মারণ রোগ সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মৃত্যু হচ্ছে গরিব মানুষের। অথচ এ বিষয়ে সরকারের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।

আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের কিছু মানুষ পাথর খাদানের কাজের জন্য ভিন রাজ্যে গিয়েছিলেন। তাঁরাই সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ফেরেন। অসহায় ওই সমস্ত গরিব মানুষের পাশে সে সময়ে সরকার দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁদের সাহায্য করেছে। সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন বিভিন্ন গণ সংগঠন, সমাজকর্মী ও আইনজীবীরা। এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল সিলিকোসিসে মৃতের পরিবারগুলিকে এককালীন ৪ লক্ষ করে টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ওই নির্দেশের পর মিনাখাঁ ব্লক এলাকার সিলিকোসিসে মৃতের ৯টি পরিবার চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেলেও অধিকাংশ পরিবার এখনও পর্যন্ত কোনও টাকা পায়নি।

সিলিকোসিসে আক্রান্ত অসহায় পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা করেন আইনজীবী সামিম আহম্মেদ। এরপরেই হাইকোর্ট ওই রায় দেয়। আইনজীবী সামিম আহম্মেদ বলেন, ‘‘সিলিকোসিসে আক্রান্ত অসহায় মানুষগুলোর কথা ভেবে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলাম। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হরিয়ানা মডেলে ক্ষতিপূরণ চালু করার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আমরা আবার আদালতের দ্বারস্থ হব।’’

সম্প্রতি এলাকার স্থানীয় কিছু যুবক সিলিকোসিসে আক্রান্ত ও মৃতের পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতে এবং তাঁদের সরকারি নানা সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’ নামে একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের সদস্য সইদুল পাইক বলেন, ‘‘আমরা সিলিকোসিসে আক্রান্ত ও মৃতের অসহায় পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতে এই সংগঠন তৈরি করেছি। আমরা তাঁদের জন্য এ বার আন্দোলন গড়ে তুলব।’’

সিলিকোসিসের মত মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে এখনও পর্যন্ত উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ ব্লকে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে সিলিকোসিসে মৃত ৯ জনের পরিবার ৪ লক্ষ টাকা করে পেয়েছেন। তবে ওই ৪ লক্ষ টাকার মধ্যে সরকারি ভাবে দু’লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়া হয় এবং দু’লক্ষ করে টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে মিনাখাঁ ব্লকের গোয়ালদহ গ্রামের বাসিন্দা আবুল পাইক ২০১৪ সালে মারা যান। আবুল অসুস্থ থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী হাসিনা বিবি তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সেক্ষেত্রে আবুলের মা মর্জিনা বিবির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৪ লক্ষ টাকা জমা পড়ে। ওই চার লক্ষ টাকার মধ্যে তিনি দু’লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলেন। আবুলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাঁর মা বাড়ির কিছুটা অংশ বন্ধক রেখেছিলেন। ওই টাকা শোধ করেন তিনি।

বাকি টাকা দিয়ে আবুলের বাবা মাছের ব্যবসা শুরু করেন। তাই দিয়ে আবুলের চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করছেন তাঁরা। সংসারের খরচও সামলাচ্ছেন। ২০১২ সালে ওই গ্রামেরই হোসেন মোল্লা মারা যান। হোসেনের বাবা রহিম বক্স মোল্লার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা পড়ে। সেই টাকা দিয়ে তিনি গ্রামে একটি ছোট ভেড়ি তৈরি করে সংসার সামলাচ্ছেন।

মিনাখাঁ ব্লকের বিডিও কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিলিকোসিসে আক্রান্ত মৃতদের কয়েকটি পরিবার ইতিমধ্যে ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। যাঁরা টাকা পাননি তাঁরা যাতে ক্ষতিপূরণ পান সে জন্য আমরা জেলায় রিপোর্ট পাঠিয়েছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘গরিব পরিবারগুলি যাতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় তার জন্য আমরা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে তাঁদের নাম ঢোকাচ্ছি। তা ছাড়া সরকারি চাল যাতে তাঁরা নিয়মিত পান সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement