বাঁধ ভেঙে প্লাবিত দুই জেলার গ্রাম

ঘরই নেই তো ঘরবন্দি

বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ জোয়ারের সময়ে মাতলা নদীর বাঁধ ভাঙে ফুলমালঞ্চ পঞ্চায়েতের গৌরদাসপাড়া এলাকায়।

Advertisement

প্রসেনজিৎ সাহা ও নির্মল বসু

বাসন্তী ও বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২০ ০৭:০৯
Share:

বিপর্যয়: বাসন্তীর গ্রামে জল ঢুকছে বাঁধ ভেঙে। নিজস্ব চিত্র

পূর্ণিমার ভরা কোটালে নদী বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হল বাসন্তী ও মিনাখাঁর বিস্তীর্ণ এলাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলাকার বহু বাড়ি-ঘর। অনেকেরই এখন ঠিকানা রাস্তা। করোনাভাইরাসের জেরে চলছে লকডাউন। যে সময়ে বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ, সেখানে এখন গৃহহীন এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ।

Advertisement

বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ জোয়ারের সময়ে মাতলা নদীর বাঁধ ভাঙে ফুলমালঞ্চ পঞ্চায়েতের গৌরদাসপাড়া এলাকায়। সেই ভাঙন দিয়ে মাতলা নদীর নোনা জল ঢুকে পড়ে গ্রামে। ধান খেত থেকে শুরু করে পুকুর, বাড়ি-ঘর সব কিছুই প্লাবিত হয়েছে ওই এলাকার চারটি গ্রামের।

প্রতি বছরই এই গৌরদাসপাড়া এলাকার লকগেট-লাগোয়া নদী বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এ বিষয়ে একাধিকবার প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। দীর্ঘ দিন ধরেই এলাকার মানুষের দাবি ছিল, এই এলাকায় কংক্রিটের নদীবাঁধ তৈরির। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তাই আরও একবার কোটালের জলের স্রোতে ভেঙে গেল নদী বাঁধ। এ দিন সকালে প্রায় ২০ ফুট এলাকা জুড়ে বাঁধ ভাঙে। আর সেখান থেকেই নদীর নোনা জল ঢুকে পড়ে গ্রামে। এর ফলে গৌরদাসপাড়া, চোরাডাকাতিয়া, কুলতলি ও পচাপাড়া— এই চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত দেড়শো পরিবারের লোকজন। নোনা জল ঢুকে পড়েছে চাষের জমিতেও। একের পর এক পুকুর প্লাবিত হয়। বহু কাঁচা বাড়ির ভিতরে জল ঢুকে গিয়েছে। ফলে সেগুলি ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বাড়িতে জল ঢুকে যাওয়ায় ঘর ছেড়ে অনেকেই বাইরে বেড়িয়ে এসেছেন। কেউ কেউ পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তো কেউ অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

Advertisement

লকডাউনের ফলে যখন সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে এই এলাকার শতাধিক পরিবার কার্যত ঘর ছাড়া হয়েছেন। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি কিংবা শারীরিক দূরত্বের বিধি নিষেধ শিকেয় উঠেছে তাঁদের। ঘরের বাইরে বেরিয়ে তাই তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। এলাকার বাসিন্দা বাসুদেব মণ্ডল বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরেই নদী বাঁধের অবস্থা খারাপ ছিল। প্রশাসনকে জানানো হয়েছে কিন্তু সারানো হয়নি। আজ বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকল। ধান জমি, পুকুর, বাড়ি সব জলের তলায়। এখন কী যে হবে তা বুঝতে পারছি না।“ সুদাম সর্দার, নুসরত ঘরামিরাও একই কথা বলেছেন। লকডাউনের ফলে রোজগার বন্ধ। ঘরে যেটুকু মজুত ছিল তা দিয়েই চলছিল সংসার, হুড়মুড়িয়ে গ্রামে জল ঢুকে যাওয়ায় সেটুকু ঘর থেকে বের করতেও পারেননি কেউ কেউ। ফলে এ বার কী ভাবে দিন কাটবে তা নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত এই গ্রামের বহু মানুষ।

বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে বাসন্তীর বিডিও অফিসের আধিকারিক, পুলিশ, সেচ দফতরের আধিকারিকরা পৌঁছন গৌরদাস পাড়ায়। সেখানে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েন তাঁরা। পরে অবশ্য সকলে মিলে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে বাঁধ মেরামতির কাজে হাত লাগান। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর ভাটার টানে নদীর জল নেমে গেলে শুরু হয় বাঁধ মেরামতি। বাসন্তী ব্লকের সেচ দফতরের আধিকারিক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা রয়েছে নদী বাঁধে। একাধিকবার মেরামতি করা হয়েছে। কিন্তু ভাঙনপ্রবণ এলাকা হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত বাঁধ মেরামতি করছি আমরা। যাতে আবার নতুন করে এই গ্রামে জল না ঢোকে সেই চেষ্টা চলছে।“ বাসন্তীর বিডিও সৌগত সাহা বলেন, “ যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের রেশন থেকে চাল, আটা দেওয়া হবে। পাশাপাশি যাঁদের জমি, পুকুরের মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদেরও সরকারি উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।“

অন্য দিকে, বসিরহাটের মিনাখাঁয় বাঁধ ভেঙে নোনা জলে প্লাবিত হল চৈতল পঞ্চায়েতের নেরুলি গ্রাম-সহ আশপাশের এলাকা। বুধবার ভোরে বিদ্যাধরী নদীর বাঁধ ভাঙায় জলবন্দী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদী সংলগ্ল গ্রামের বেশ কিছু ঘর-বাড়ি। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় স্থানীয় প্রশাসন।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন ভোরে বিদ্যাধরী নদীর প্রায় পঞ্চাশ ফুট বাঁধ ভেঙে যায়। হুমায়ুন বৈদ্য, আয়ূব বৈদ্য বলেন, ‘‘ভোরে বাঁধের বেশ কিছুটা ধসে নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় গ্রামের মধ্যে জল ঢুকে পড়ে। প্লাবিত হয় মেছোভেড়ি। পঞ্চায়েতের সাহায্যে গ্রামের মানুষ বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষায় দ্রুত নেমে পড়েন।’’ এই খবর পেয়ে বিডিও-সহ বিভিন্ন আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে আসেন। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বিদ্যাধরী নদীর বেশ কিছু এলাকায় বাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। ন্যাজাটের এক জায়গাতেও বাঁধ বসে গিয়েছে।

এ দিকে, হিঙ্গলগঞ্জের সুন্দরবনের সাহেবখালিতে স্ল্যুইস গেটের পাশে বাঁধ বসে গিয়ে গ্রামের মধ্যে নোনা জল ঢুকতে শুরু করেছে। বসে গিয়েছে ইটের রাস্তা। অবিলম্বে মেরামতীর কাজ করা না হলে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হতে পারে। পঞ্চায়েত সদস্য দেবাশিস মহাজন, দেবদূত মণ্ডল বলেন, ‘‘গত বৃহস্পতিবার সকালে হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলি পঞ্চায়েতের ২ এবং ৩ নম্বর সাহেবখালির মাঝে কালিন্দী নদীর বাঁধে স্ল্যুইস গেটের পাশে বড় ধরনের ফাটল দেখা যায়। ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কাজ শুরু না হওয়ায় মঙ্গলবার স্ল্যুইস গেটের পাশে মাটি বসে গিয়ে আশপাশের তিনটি গ্রামে নোনা জল ঢুকে যায়।’’

স্থানীয় বিধায়ক দেবেশ মণ্ডল বলেন, ‘‘সাহেবখালিতে স্ল্যুইস গেটের পাশে বাঁধ মেরামতির জন্য পঞ্চায়েতকে বলা হয়েছে। পঞ্চায়েতের পক্ষে বাঁধ মেরামতি সম্ভব না হলে সেচ দফতরকে বলা হবে।’’

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement