আধুনিক মেশিন বসেনি, লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাদুড়িয়ার ক্ষুদ্রশিল্প

কোনও বার গিয়ে দেখেন, ভোট পড়ে গিয়েছে। কোনও বার ভোটের আগের রাতে ঘন আঁধার ঠেলে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতীরা এসে বলে যায়, ‘‘কাল আর বুথে যেতে হবে না। আমরাই বুঝে নেব।’’

Advertisement

নির্মল বসু

বাদুড়িয়া শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০২:২৩
Share:

হাতে সেলাই করে ক’টা টাকাই বা পান এঁরা। কবে বদলাবে পরিস্থিতি? নিজস্ব চিত্র।

কোনও বার গিয়ে দেখেন, ভোট পড়ে গিয়েছে।

Advertisement

কোনও বার ভোটের আগের রাতে ঘন আঁধার ঠেলে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতীরা এসে বলে যায়, ‘‘কাল আর বুথে যেতে হবে না। আমরাই বুঝে নেব।’’

শোনা গেল, দুয়ারে চাল, কাপড় রেখে যাওয়া হয় ভোটের আগের দিন। সেই উৎকোচে না ভুললে আরও একপ্রস্থ হুমকি, শাসানিও চলে।

Advertisement

তবে ভয়, বাধা ঠেলে ভোর থাকতে বুথের বাইরে লাইন দেন বাদুড়িয়ার শুকপুকুরিয়ার মানুষজন। ভোট দেন এই আশায়, এ বার বুঝি নেতারা মুখ তুলে চাইবেন। সংসারের হাল ফিরবে। কিন্তু প্রতিবারই পরিস্থিতি একই থেকে যায়।

কেমন সেই পরিস্থিতি?

বাদুড়িয়া ব্লকের নানা প্রান্তে শুকপুকুর, আরশুলা, বৈকারা, গুড়দহরাজাপুর, আগাপুর, শেরপুর, তারাগুনিয়া-সহ ক্ষুদ্র শিল্পের কেন্দ্র আছে বেশ কিছু। বাড়ির মেয়ে-বৌরাই মূলত ঘরে বসে সে সব কাজ করেন। সংগঠিত ভাবে ছোট ছোট কারখানাতেও কাজ হয়। তবে তার সংখ্যা কম। কোথাও হাতে সুতোর কাজ হয়। কোথাও কাঁথা সেলাই হয়, তা-ও সেই হাতে। হাতপাখা তৈরির সঙ্গেও যুক্ত অনেকে। দড়ি তৈরি, সুপারি ছাড়ানো, অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স তৈরির মতো আরও কিছু কিছু শিল্প আছে এই এলাকায়। যতটুকু আছে, তা-ও বসিরহাট মহকুমার অন্য প্রান্তে বড় একটা দেখা মেলে না। বাদুড়িয়ার বেশ কয়েক হাজার মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত।

কথা হচ্ছিল বাদুড়িয়া পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শুকপুকুরিয়া গ্রামের রূপা বিবির সঙ্গে। ভ্যানচালক স্বামী এবং পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। সূচ-সুতো দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলেন রূপা। স্থানীয় ভাষায়, ‘কাম সেলাই।’ মূলত বারাসতের কদম্বগাছি এলাকা থেকে কাপড় আনে বাদুড়িয়ার কয়েকজন। তাদের হাত মারফত সেলাইয়ের কাজ নেন রূপার মতো কয়েক হাজার মহিলা।

বাদুড়িয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের এই মহিলাদের হাতের কাজের দেশ-বিদেশে নামডাক আছে। ব্যবসায়ীরা ভালই লাভ করেন সে সব মাল বেচে। কিন্তু দিন-রাত এক করে কাজ করে কেমন রোজগার রূপাদের? অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছর দশেক আগেও যে কাপড়ে নকশা তুললে মজুরি মিলত ২৪০ টাকা। এখন মেলে মেরেকেটে ১১০ টাকা।

সারা দেশে যখন সব জিনিসের দাম বাড়ের দিকে, তখন এখানকার মহিলাদের মজুরি দিন দিন কমল কী করে?

জানা গেল, মেশিনে সেলাইয়ের চাহিদা বাড়ায় হাতে সেলাই যাঁরা করেন, তাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা মেশিন বসিয়ে সেলাই করেন। যাঁদের পুঁজি নেই, তাঁরা হাতেই কাজ সারেন। আর রোজগার করেন অনেক কম।

মেশিন বসেনি অন্য শিল্পে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ লোকই এখনও দড়ি পাকান হাতে। যাঁরা মেশিন বসাতে পেরেছেন, তাঁদের রোজগার তুলনায় বেশি। জাহানারা বিবির বয়স ষাট পেরিয়েছে। বললেন, ‘‘কাঁথা সেলাই করে সংসার চালাতে হয়। দেড় মাস ধরে টানা কাজ করলে তবেই একটা কাজ শেষ হয়। দাম পাই বড় জোর আড়াইশো-তিনশো টাকা। এক কিলো সুপারি ছাড়ালে মেলে ৩ টাকা। এ ভাবেই চলছে।’’

মেশিনপত্র বসানোর জন্য বহুবার নেতাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন। আর পাল্টা মিলেছে রাশি রাশি প্রতিশ্রুতি। সে সব ভোটের আগে বেড়েছে, জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

কিন্তু ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য আধুনিকীকরণের কোনও পাকাপাকি ব্যবস্থাই হয়নি। সরকারি সাহায্যও মেলেনি কোনও রকম। তবু পঞ্চায়েত ভোট থেকে শুরু করে পুরসভা, বিধানসভা কিংবা লোকসভা ভোটের আগে প্রচারে এসে নেতা-নেত্রীরা বলে গিয়েছে, মজুরি বাড়বে, যন্ত্র বসবে, একটু শুধু অপেক্ষা করুন।

সেই অপেক্ষা করতে করতেই বছরের পর বছর পেরিয়েছে। আর ভোটের আগে মিলেছে নানা হুমকি। ছাপ্পা ভোটের জন্য অনেকে ভোট দিতেও পারেননি।

বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান তথা তৃণমূল নেতা তুষার সিংহের কথায়, ‘‘এখানে হুমকি দেওয়ার রাজনীতি হয় না। মানুষ উৎসবের মেজাজে ভোট দেন। তবে শিল্পের জন্য আধুনিক মেশিনপত্র আনা দরকার। সেই চেষ্টা চলছে।’’

কংগ্রেসের এ বার প্রার্থী আব্দুর রহিম দিলুর কথায়, ‘‘এখানে সকলে মিলেমিশে ভোট করে। মারামারি হয় না। কেউ হুমকি দেয় বলে শুনি। তবে শিল্পের উন্নতি হলে কর্মসংস্থান বাড়বে, সেটা আমরাও চাইছি।’’

সিপিএম নেতা অনিমেশ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমরা এখানে বেশি বেশি করে শিল্প চাই। তা হলেই মানুষের উন্নতি হবে। ভয় দেখানো, হুমকির রাজনীতি এখানে চলে না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement