কেউ এক দিন স্কুলে না এলেই খবর নেয় ‘আজকের সূর্য’

Advertisement

নব্যেন্দু  ঘোষ

সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:৩১
Share:

বই-মুখে: গ্রামের মেয়েরা। নিজস্ব চিত্র

ক’দিন ধরে স্কুলে যাচ্ছিল না মেয়েটি। সেটা ২০১৩ সালের কথা। খবরটা কানে ওঠে ‘আজকের সূর্য’ দলের সদস্যদের। পঞ্চম শ্রেণির ওই পড়ুয়ার বাড়িতে হাজির হয় ছেলেমেয়ের দল। জানতে পারে, মেয়ে গিয়েছে মামার বাড়িতে। কিন্তু বাবা-মায়ের কথাবার্তা ভাল ঠেকেনি দলের সদস্যদের। আরও খোঁজ-খবর করে তারা জানতে পারে, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। বিষয়টা পঞ্চায়েত প্রধানকে জানানো হয়। বন্ধ করা যায় বিয়ে।

Advertisement

২০০৫ সাল থেকে সন্দেশখালি ১ ব্লকের আগারহাটি পঞ্চায়েতে এ ভাবেই কাজ করে চলেছে ‘আজকের সূর্য’। তারই স্বীকৃতি মিলেছে সম্প্রতি। এ বছর কেন্দ্র সরকারের পঞ্চায়েতিরাজ মন্ত্রকের থেকে ‘সেরা শিশুবান্ধব গ্রাম’ নির্বাচিত হয়েছে তারা। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এ কাজে পঞ্চায়েতটির পাশে থেকেছে।

এলাকায় মূলত দরিদ্র মানুষের বাস। শিক্ষার হারও খুব কম। জানা গেল, কিছু বছর আগেও এই পঞ্চায়েত এলাকায় শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা প্রচুর ঘটত। কী ভাবে সমস্যায় আগল দেওয়া যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয় নানা স্তরে। ২০০৫ সাল নাগাদ পঞ্চায়েতের উদ্যোগে ৭ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি হয় ‘আজকের সূর্য’। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, মানব পাচার — এ সব রুখতে দলের সদস্যদের তালিম দেওয়া হয়।

Advertisement

দলের সদস্য মমতা সর্দার, আর্জিনা খাতুন, রাহুল সর্দার, আজিজ সর্দাররা জানায়, কোনও সমস্যার খবর পেলে তারা নিজেরাই প্রথমে হাজির হয়। যদি কথাবার্তা বলে সমস্যা মিটাতে পারল তো ভাল, না হলে পঞ্চায়েত স্তরে সে খবর জানায়। দলের সদস্যদের কথায়, ‘‘মেয়েরা কোথাও ঘুরতে গিয়েছে শুনলেই আমাদের চোখ-কান সতর্ক হয়ে যায়। এমন বহু ঘটনায় দেখা গিয়েছে, ছোট ছোট মেয়েদের অন্যত্র পাঠিয়ে হয় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, না হলে পরিচারিকার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়।’’

দলের সদস্য রবিনা খাতুন, শুভদীপ সর্দাররা বলে, ‘‘২০১৪ সাল নাগাদ এই পঞ্চায়েতের গোলকুপিয়া গ্রাম থেকে আমাদের দলের সাত-আট বছরের দুই সদস্য খবর দেয়, গ্রামে গাড়ি নিয়ে একটা লোক সন্ধের দিকে ঢুকেছে। গরিব একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলছে। খবর পাওয়া মাত্রই সকলে হাজির ওই বাড়িতে। দেখা যায়, সেখানে চার জন নাবালিকা রয়েছে। যিনি শহর থেকে এসেছিলেন, তিনি এক জন পরিচারিকার কাজের টোপ দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। প্রশ্ন করা শুরু করলে এক সময়ে কোনও মতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান ওই ব্যক্তি।

কোনও খেলার সাথী বা সহপাঠীকে একদিন দেখতে না পেলেও খবর দেয় অন্যদের। ‘আজকের সূর্য’ দলের যোদ্ধারা বলে, ‘‘আমাদের বয়স কম বলে আগে অনেকে পাত্তা দিতে চাইত না। তবে এখন এই পঞ্চায়েত এলাকার পরিস্থিতি পাল্টেছে।’’ সদস্যেরা জানায়, এখন এখানে অল্প বয়সে কাউকে আর বিয়ে দেওয়া হয় না। শিশুশ্রম নেই। তবে লড়াইটা জারি রাখা দরকার। না হলে যে কোনও সময়ে অঘটনের আশঙ্কা থেকেই যায়।পঞ্চায়েতের প্রধান শাজাহান শেখ বলেন, ‘‘এই বাচ্চাদের এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এরা জানে কী ভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কী ভাবে অভিভাবকদের বোঝাতে হয়। এদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য পেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করি আমরা।’’

বিডিও সুপ্রতিম আচার্য বলেন, ‘‘এই পঞ্চায়েত শিশুদের নিয়ে দারুণ কাজ করেছে। আমরা আগামী দিনে চেষ্টা করব, এই মডেল অন্যান্য পঞ্চায়েতেও প্রয়োগ করতে।’’

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও পঞ্চায়েতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে বলে জেনেছেন বিডিও। ওই সংগঠনের তরফে পরমেশ্বর খাঁ বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরে গ্রামে এই কাজ হচ্ছে। আয়লার পরে শৈশবের সমস্যা এ সব এলাকায় আরও বেড়েছিল। তবু সকলে মিলে কাজ করে পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দেওয়া গিয়েছে। পঞ্চায়েতের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement