আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি সুমেরুর লক্ষ্যে কলকাতা থেকে নরওয়েগামী বিমানে উঠবেন করুণাপ্রসাদেরা। ফাইল ছবি।
কর্মজীবন থেকে অবসর মানেই সব শেষ নয়, বরং এ এক নতুন শুরু। সত্তরে জবুথবু নয়, বরং নতুন উদ্যমে বাঁচা— আর পাঁচ জন গড়পরতা মানুষের কাছে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চাইছেন নৈহাটির করুণাপ্রসাদ মিত্র। আর তাই চলতি মাসে উত্তর মেরু অভিযানে নামছেন সত্তুরে ওই ‘যুবক’।
তবে করুণাপ্রসাদ একা নন। এই অভিযানে তাঁর সঙ্গী আরও তিন জন। রয়েছেন প্রাক্তন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ঢাকুরিয়ার বছর সত্তরের আরও এক ‘যুবক’। আছেন বছর চৌষট্টির এক প্রৌঢ়ও। তবে তাঁরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। করুণাপ্রসাদ বলছেন, ‘‘ঢাকুরিয়ার সঙ্গীও আমার মতোই অবিবাহিত। আমার সঙ্গে আগে কিলিমাঞ্জারো অভিযানেও গিয়েছেন। কিন্তু এখন সামনে আসতে চান না।’’
নৈহাটি পুরসভার প্রাক্তন কর্মী করুণাপ্রসাদ দেশের ৪৫টি শৃঙ্গে অভিযান চালিয়েছেন। পৌঁছেছেন আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গেও। কিন্তু বরফের দেশের প্রতি টান ছিল বরাবরই। ‘‘আরও বেশি বয়সে বরফের দেশে যাওয়াটা হয়তো আরও কষ্টকর হবে। তাই সুমেরুটা এ বারেই সেরে ফেলতে চাইছি।’’— বলছেন করুণাপ্রসাদ। তাই তাঁর অভিযানের নাম— ‘৭০-এ উত্তরে’।
আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি সুমেরুর লক্ষ্যে কলকাতা থেকে নরওয়েগামী বিমানে উঠবেন করুণাপ্রসাদেরা। ২৬ দিনের এই সফরে ফিনল্যান্ড ছুঁয়ে পৌঁছবেন আইসল্যান্ডে। সারা জীবনের সঞ্চয় থেকেই অভিযানের খরচ বহন করছেন তাঁরা। এর পরে আইসল্যান্ড থেকে জাহাজ নিয়ে সোজা পাড়ি সুমেরুর দিকে। বরফ কাটার ওই বিশেষ জাহাজ যেখানে নামাবে, সেখান থেকে সুমেরু আরও ২৫ কিলোমিটার। বরফের উপর দিয়ে হেঁটেই সে দিকে এগোবেন তাঁরা, রাত কাটবে ইগলুতে। করুণাপ্রসাদ বলছেন, ‘‘এই বয়সে যত দূর এগোনো সম্ভব, তত দূরই যাব। দুঃসাহস দেখাতে চাই না। তবে এলব্রুস অভিযানে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ঠেলে এসেছিলাম। তাই ঠান্ডা অতটা কাবু করতে পারবে না বলেই মনে হয়। অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে রোজ জিমে যাই। এক সময়ে বডি বিল্ডিং করতাম। আজও লোকে আমায় দেখে বয়স ধরতে পারে না। ষাটোর্ধ্ব অনেকেই ট্রেনে উঠে আমায় সিট ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন!’’
করুণাপ্রসাদের বিদেশে অভিযানের শুরুটা হয়েছিল অবসরের হাত ধরেই। তিনি জানাচ্ছেন, ২০১৪ সালে এভারেস্টের প্রস্তুতি নিলেও সে বছরই অবসর নেওয়ার কথা ছিল তাঁর। তাই ছুটি নিলে পেনশন আটকে যাওয়ার আশঙ্কায় আর যাওয়া হয়নি। এর পরে বন্ধু প্রশান্ত মণ্ডল বলেন রাশিয়ার এলব্রুসের কথা। ভিসা, পাসপোর্ট বানিয়ে বন্ধুর সঙ্গেই ২০১৬ সালে প্রথম দেশের বাইরে অভিযান। এর পরে ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কোজ়িচিয়াস্কো, ২০১৯-এ আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো আরোহণ। তার পরেই সুমেরুর কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন করুণাপ্রসাদ। কিন্তু অতিমারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পথ বন্ধ ছিল। এ বছর রাস্তা খুলতেই আর দেরি করতে চাইছেন না তাঁরা।
বেশি বয়সে শৃঙ্গাভিযানের বেশ কিছু নজির রয়েছে বিদেশি পর্বতারোহীদের। সম্প্রতি পঞ্চাশোর্ধ্বা ১০ জন মহিলাকে নিয়ে হিমালয়ে পাঁচ মাসব্যাপী অভিযান চালিয়েছেন বিশিষ্ট পর্বতারোহী, ৬৮ বছরের বাচেন্দ্রী পাল। তাঁদের মতোই সুমেরুর পথে এগিয়ে বাকিদের আশার আলো দেখাতে চান করুণাপ্রসাদ। বলছেন, ‘‘অনেকেই ভাবেন, অবসরের পরে কিছুই করার নেই। তাঁদের মনে করাতে চাই, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। জবুথবু হয়ে নয়, সত্তরেও জমিয়ে বাঁচুন।’’