অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীকে যোগ্য সুযোগ দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস মাঠে নামবে। যদি কেউ ভাবে মুখ দেখিয়ে, দাদার জলের বোতল বয়ে পঞ্চায়েতের আসন পাব, কাছের লোক হয়ে আসন পাব, তা হবে না। মানুষ যদি সার্টিফিকেট দেয় তবেই আপনি তৃণমূলের প্রার্থী হবেন। যতবার নেতার ছত্রছায়ায় থাকুন আপনাকে তৃণমূল পঞ্চায়েতের টিকিট দেবে না।’’ বললেন অভিষেক।
অভিষেক বললেন, ‘‘আজকে তৃণমূল বাংলায় গণ্ডীবদ্ধ নয়, মেঘালয়ে ঢুকেছে, অসমে ঢুকেছে, ত্রিপুরায় ঢুকেছে গোয়ায় ঢুকেছে। দল এক বছর হল আমাকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করেছিল। এই দায়িত্ব আমাকে নেত্রী মমতা দিয়েছিলেন। দলীয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমিও ঠিক করেছি, যতদিন না সর্বভারতীয় স্তরে প্রত্যন্ত প্রান্ত নেত্রীর আদর্শকে এবং বাংলার জোড়াফুল পৌঁছে দিচ্ছি আমি নিশ্চিন্তে শ্বাস নেব না। তাতে যতদিন লাগে লাগুক। আমি এই জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। দলের জন্য উৎসর্গ করেছি। দল মায়ের মতো, দলের জন্য সর্বদা লড়াই করতে প্রস্তুত। কথা দিচ্ছি, যেখানে দরকার আমি নিজে যাব। এক ছটাক জমি বিজেপিকে ছাড়বে না।’’
২১ জুলাই শুধু তৃণমূলের প্রতি জনতার সমর্থনের মাপকাঠি নয়, জানিয়ে দিলেন অভিষেক। বললেন, ‘‘২১ জুলাই হার না মানার মানসিকতা, বুক চিতিয়ে মাঠে নেমে রক্ত দিয়ে লড়াই করার মানসিকতা। তাই এ বছর ২১ এর নতুন শপথ। তৃণমূল কংগ্রেস করতে হলে মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৃণমূল নিজের করে খাওয়ার জায়গা নয়। যদি তাই করতে হয়, তবে ঠিকাদারী করুন। আর না হলে তৃণমূল করুন। কিন্তু তৃণমূল করতে হলে নিস্বার্থভাবে করতে হবে। নির্ভীক, নির্লোভ ভাবে করতে হবে।’’ অভিষেক জানালেন, ‘‘তৃণমূল করতে গেলে দলীয় অনুশাসন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তাধারা, নেত্রীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উৎসর্গীকৃত হয়ে করতে হবে’’
পদ প্রাক্তন হতে পারে। কিন্তু দলের কর্মীরা প্রাক্তন হতে পারে না। আমি দলের কর্মী হয়েই থাকতে চাই, জানালেন অভিষেক
বাংলার টাকা বাংলা জোগাবে, দিল্লির কাছে হাত পাতবে না পশ্চিমবঙ্গ, বললেন অভিষেক। অভিষেকের কথায়, ‘‘কেন্দ্র বাংলার টাকা বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০ দিনের কাজের ৯ হাজার কোটি টাকা বন্ধ করেছে কেন্দ্র। সড়ক যোজনার সাড়ে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকাও বন্ধ। বাংলা আবাস যোজনায় সাড়ে ছ’হাজার কোটি বন্ধ। বিজেপির নেতারা বলেছে মোদীকে বলে বাংলার টাকা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে বাংলার ক্ষতি ওরা করতে পারবে না। বাংলার নিজের টাকা নিজেই জোগাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে সময় দিন। তবে কেন্দ্রের চাপে পড়ে আমরা মাথা নোয়াবো না। কেন্দ্র চেয়েছিল কেন্দ্রের নামে প্রকল্প করতে হবে, তবেই টাকা দেবে কেন্দ্র। কিন্তু অন্য দলগুলির মতো এই চাপের কাছে আত্মসমর্পন করিনি। আমরা বলেছি, বাংলার প্রকল্প হলে শুধু বাংলার নামেই হবে। বাংলা আবাস যোজনা হবে। বাংলা সড়ক যোজনা হবে। তাতে যদি কেন্দ্র টাকা না দিতে চায় বাংলার সেই টাকা লাগবে না। বাংলা কেন্দ্রের ভরসায় ছিল না। থাকবেও না। বাংলাই নিজের রাস্তা নিজে বানাবে।
এই তৃণমূল বিশুদ্ধ লোহা। মিরজাফর নেই এই দলে। এই দলকে যত তাতাবে ততই শক্ত হবে। যারা ভেবেছিল কয়েকটা নকুলদানা ভেঙে নিয়ে গিয়ে তৃণমূলকে জব্দ করবে, তৃণমূলকে বাংলা ছাড়া করবে, তারা জবাব পেয়ে গিয়েছে, বললেন অভিষেক।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়েই মঞ্চে উঠেছিলেন অভিষেক। তবে মঞ্চে উঠে জনতার কাছে জানতে চাইলেন, ছাতা রাখবেন নাকি সরিয়ে দেবেন। শেষে বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ভিজেই বক্তৃতা শুরু করলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘‘বৃষ্টি শুভ। যতবার ২১ জুলাই বৃষ্টি হয়েছে বিরোধীরা ধুয়ে গিয়েছে। এ বারও ২১ জুলাইয়ের সর্বকালীন রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছেছ’ বছর ছিলাম যুব সভাপতি এত ভিড় দেখিনি। তবে আমার দেখে ভাল লাগছে যে এই বৃষ্টিতেও কেউ আসন ছাড়েননি। এই জেদই এগিয়ে নিয়ে যাবে তৃণমূলকে। এই জেদ শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচন নয়। দিল্লির বুকে গণতান্ত্রিক গঠনমূলক সরকার তৈরির সূচনা এই সমাবেশ।’’
শহিদ ফলকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মঞ্চে উঠলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুর ১২টা নাগাদ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এসে পৌঁছলেন তৃণমূলের শহিদ স্মরণের মঞ্চে। পরনে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি, গলায় সাদা উত্তরীয়। অভিষেক মঞ্চে উঠেই মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে করে অভিবাদন জানালেন উপস্থিত জনতাকে। মঞ্চে তখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা লোকসভা সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যেই অভিষেক মঞ্চে ওঠায় এক মিনিট থামতে হল সুদীপকে। কারণ অভিষেককে দেখে তখন করতালিতে ফেটে পড়েছে ধর্মতলা চত্বরের ২১ জুলাইয়ের জমায়েত।
শেষবার তাঁকে তৃণমূলের শহিদ দিবসের মঞ্চে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন অভিষেক যুব তৃণমূলের সভাপতি। মাঝখানের দু’বছর অর্থাৎ ২০২০ এবং ২০২১ সালেও অভিষেক ছিলেন। তবে ভার্চুয়াল সমাবেশে। অতিমারির কথা মাথায় রেখে ওই দু’বছর তৃণমূল তাদের শহিদ দিবসে কোনও জনসভা করেনি। ফলে সেদিক দিয়ে দেখলে ২০১৯ এর পর এটিই পুরোদস্তুর ময়দানে নেমে তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ।
তবে এই দু’বছরে তৃণমূলে যেমন বদল এসেছে, তেমনই বদলেছেন অভিষেকও। ২০১৯ সালে অভিষেক ছিলেন যুব তৃণমুলের সভাপতি। তৃণমূল তখন দ্বিতীয়বার বাংলাজয়ী রাজনৈতিক দল। যারা সদ্য লোকসভা ভোটে বেশ কিছু আসন হারিয়েছে। সে বছর মে মাসে প্রকাশিত লোকসভা ভোটের ফলাফলে বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্যে কেবল ২২টিতে জিতেছিল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ৩৪টি আসনের তুলনায় ফল খারাপই। ওই ফলপ্রকাশের দু’মাসের মধ্যেই ছিল ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ।
তৎকালীন যুব তৃণমুলের সভাপতি অভিষেক অবশ্য তাঁর লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে জিতেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটের ব্যবধানে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বীকে। তখন থেকেই দলে আলাদা করে নজরে পড়তে শুরু করেছিল তাঁর ভূমিকা। তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের বক্তব্য, রাজ্যের তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি করে তৃণমূলে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা ‘বাংলার যুবশক্তি’ ২০২০ সালে গিয়ে কার্যকর হবে, তার ভাবনাচিন্তাও অভিষেক শুরু করেছিলেন তখনই।
সেই অভিষেক এখন রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। বাংলা ছেড়ে বাংলার বাইরের রাজ্যে বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে লড়ছে যে তৃণমূল, তার ভার অভিষেকের কাঁধে দিয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বছর সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের শহিদ সমাবেশ পালন করা হচ্ছে। অভিষেক জানিয়েছেন, বাংলার বাইরের বিভিন্ন রাজ্য থেকে তৃণমূলের নেতারা এসেছেন সমাবেশে যোগ দিতে। সেই মঞ্চে প্রথম দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদমর্যাদায় ‘অভিষেক’ হচ্ছে অভিষেকের। তৃণমুলের আগামী দিনের নীতি, কর্মসূচির রূপায়ণ বিচার্য হলে এই মঞ্চে অভিষেকের বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাড়তি গুরুত্বের।