রমেশ ঘোষালের শোকাহত পরিজনেরা।
ফের ভাঙড়। ফের সেই আরাবুল ইসলাম!
কলেজ শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারা থেকে শুরু করে প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলা একের পর এক ঘটনায় তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের নাম উঠে এলেও তাঁকে বরাবরই ছাড় দিয়ে এসেছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই প্রশ্রয়ে লাগামছাড়া আরাবুল গোষ্ঠী শনিবার তাণ্ডব চালাল ভাঙড়ে। তৃণমূলেরই অন্য এক গোষ্ঠীর উপরে সেই হামলার জেরে পনেরো মিনিটের ব্যবধানে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। জমি কেনাবেচার দালালির বখরা নিয়ে গোলমাল আর এলাকা দখলে রাখার মরিয়া চেষ্টাই এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নেপথ্যে, জানাচ্ছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতাদেরই একাংশ।
দলের ব্লক সভাপতি ওহিদুল ইসলামের অনুগামীদের সঙ্গে কিছু দিন ধরেই বিরোধ চলছিল আরাবুল অনুগামীদের। তার জেরে এ দিন সকাল থেকেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় ভাঙড়-২ ব্লকের বেঁওতা গ্রাম। দফায় দফায় গুলি চলে। ব্যাপক বোমাবাজি হয়। তখন ওহিদুল অনুগামী হিসেবে পরিচিত রমেশ ঘোষালের (৪২) বাড়িতে ভাইফোঁটার তোড়জোড় চলছিল। তারই মাঝে ঢুকে পড়ে তাঁর পেটে-বুকে চারটি গুলি করে এক দল যুবক। তারা আরাবুলের অনুগামী বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ঘটনাস্থলেই রমেশের মৃত্যু হয়। তাঁর বাড়ি, দু’টি মোটরবাইক ও কাপড়ের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাপন মণ্ডল (১৯) নামে আর এক তৃণমূল কর্মী। তিনি আরাবুল-অনুগামী হলেও নিজের গোষ্ঠীর লোকেদেরই ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাঁর গায়ে লাগে বলে পুলিশের অনুমান। আরাবুলের অবশ্য দাবি, তিনি বা তাঁর কোনও অনুগামী এ দিনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন।
কেন এ দিন হঠাৎ উত্তপ্ত হল বেঁওতা গ্রাম?
স্থানীয় গ্রামবাসী ও তৃণমূূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, গোলমালের সূত্রপাত কয়েক মাস আগেই। চারটি সংস্থা বেঁওতা-১ এবং বেঁওতা-২ পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৭০০ বিঘা জমি কিনবে বলে স্থির করে। তার মধ্যে ৪০০ বিঘা জমি কেনা হয়ে গিয়েছে। এই জমি কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে শাসক দলের ছত্রছায়ায় সক্রিয় হয়েছে একটি চক্র। যারা দালালি আদায় করছে। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, মোট দালালির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দুই পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানরা যে হেতু ওহিদুল-ঘনিষ্ঠ, তাই দালালিতে ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুলের নিয়ন্ত্রণ থাকছিল না। সেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে তিনি নিজের দলেরই পঞ্চায়েত প্রধানদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অনাস্থায় হেরে মাসখানেক আগেই বেঁওতা-২ পঞ্চায়েতের প্রধান মর্জিনা বিবিকে পদ থেকে সরতে হয়। তার পর আরাবুলের ‘কোপে’ পড়েন বেঁওতা-১ পঞ্চায়েতের প্রধান সত্যজিৎ মণ্ডল ওরফে পাঁচু। সরতে হয় তাঁকেও। তা সত্ত্বেও পদচ্যুত ওই প্রধানদের অনুগামীদের দাপটে জমি লেনদেনের দালালিতে ভাগ বসাতে পারছিলেন না আরাবুল। ফলে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক দিন ধরেই আরাবুল এবং ওহিদুল গোষ্ঠীর মধ্যে মারধর, হুমকি, শাসানি, পাল্টা শাসানি ঘিরে গ্রামে উত্তেজনা ছিল। বৃহস্পতিবারই মারধর করে রমেশের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে শুক্রবার রাতে পুলিশের একটি
টহলদার গাড়ি পাঠানো হয় গ্রামে। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ লাঠি, রড, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রমেশের বাড়িতে চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা গুলি-বোমা ছুড়তে ছুড়তে ঢোকে। রমেশের স্ত্রী আশাদেবী বলেন, “আরাবুলের লোকজনের পা জড়িয়ে ধরেছিলাম। বলেছিলাম, টাকা লাগলে দেব। স্বামীকে মেরো না। ওরা শুনল না।”
রমেশকে খুন করার পরে দুষ্কৃতীরা পাশেই পাঁচুবাবুর বাড়িতে চড়াও হয়। বিপদ বুঝে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালান পাঁচুবাবু। তাঁর কথায়, “দিন কয়েক আগেও আরাবুল বাহিনী রাস্তায় আমার উপরে চড়াও হয়েছিল। এ দিন রমেশের বাড়ি থেকে ওরা আমার বাড়িতে আসছিল। আমি ছেলেকে নিয়ে পালাতে থাকি। উল্টো দিক দিয়ে আরাবুলের আর একটি বাহিনী গুলি চালাতে চালাতে আসে। আমাকে লক্ষ করে গুলি চালায়। আমি ছেলেকে নিয়ে নয়ানজুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
বাপন মণ্ডলের শোকাহত পরিবার।
ওই গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাপনের গায়ে লাগে।”
ঘটনাস্থলেই বাপনের মৃত্যু হয়। মৃতদেহটি তাঁর বাড়ির সামনে রেখে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন আরাবুল-অনুগামীরা। চলে আসেন আরাবুলও। তার ফাঁকে পাঁচুবাবুরও বাড়িতে এবং মোটরবাইকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রমেশের দেহ উদ্ধার করার পরে বাপনের দেহ উদ্ধারে গিয়ে বাধা পায় পুলিশ। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ চলে। পরে জেলা পুলিশের কর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেহ উদ্ধার করেন। এলাকায় বিশাল পুলিশ বাহিনী এবং র্যাফ মোতায়েন করা হয়।
এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে ভাঙড়ে তৃণমূূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন নয়। গত চার বছরে বহু বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে আরাবুল এবং দলের জেলা পরিষদ সদস্য কাইজার আহমেদের অনুগামীরা। দলের রাজ্য স্তরের নেতাদের সামনেও প্রকাশ্যে এসেছে সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বছরখানেক আগেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তৃণমূল যুবার এক সভায় হাতাহাতিতে জড়িয়েছিলেন আরাবুল এবং কাইজার। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়েও যাদবপুর কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী সুগত বসুর সমর্থনে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের একটি সভায় দুই গোষ্ঠী হাতাহাতিতে জড়ায়। চলতি বছরের গোড়ায় ভাঙড়-১ ব্লকে তৃণমূল নেতা রজ্জাক সর্দার খুনের পিছনেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইঙ্গিত মিলেছিল।
আগুনে পুড়ে ছাই রমেশ ঘোষালের বাড়ির আসবাবপত্র।
এত কিছু সত্ত্বেও আরাবুলের বিরুদ্ধে কখনওই কোনও ব্যবস্থা নেননি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। এমনকী, রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলার পরে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র আরাবুলকে ‘তাজা নেতা ও দক্ষ সংগঠক’ বলে প্রশংসাও করেছিলেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশই বলছেন, রাজ্য নেতৃত্বের প্রশ্রয় পেয়েই ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন আরাবুল। যার পরিণতি আজকের ঘটনা।
আরাবুল অবশ্য গোটা ঘটনার জন্য পাঁচুবাবুকে দায়ী করেছেন। জমির দালালির কথা অস্বীকার করে তাঁর দাবি, “রমেশ আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। পাঁচুর নেতৃত্বেই হামলা হয়েছে। আমি ঘটনার পরে গিয়েছি।”
যদিও দলীয় নেতাদের যে কোনও অপকর্মকে সাধারণ ভাবে ‘ছোট ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশেষে আরাবুলের উপরে ক্ষুব্ধ বলে তৃণমূলের অন্দরের একটি সূত্রের দাবি। মুকুল রায়কে গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
আর দু’জন খুন হওয়ার পরেও তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “এটা যে হেতু দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, দলের জেলা নেতৃত্বকে দ্রুত রিপোর্ট পাঠাতে বলেছি।” ওই রিপোর্ট পেলে মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী, অরূপ বিশ্বাস এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। দলের কেউ দোষী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন পার্থ।
পাঁচু মণ্ডলের পোড়া মোটরবাইক। ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণকুমার ত্রিপাঠী।
তৃণমূল সূত্রের অবশ্য দাবি, পুলিশ-প্রশাসনকেও এ বার নিরপেক্ষ ভাবে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও এ দিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত দুই তৃণমূল কর্মীর পরিবার এবং গ্রামবাসীরা। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশের সামনেই হামলা হল। অথচ, পুলিশ ছিল দর্শক। বস্তুত, পুলিশের যে টহলদার গাড়ি ওই গ্রামে ছিল, সেখানে দুই কনস্টেবল এবং এক জন এএসআই ছিলেন। রমেশ খুনের পরে আরও কিছু পুলিশ আসে। কিন্তু তাঁদেরই বক্তব্য, শুধু লাঠি হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। তাই তাঁরা এগোতে সাহস করেননি। পরে অবশ্য আশপাশের থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী আসে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “পুলিশের সামনেই গুলি চলার কথা আমারও কানে এসেছে। বিভাগীয় তদন্ত করা হবে।” এ দিনের ঘটনায় রাত পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ভাঙড়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরও এক বার শাসক দলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “যা চলছে তাকে আর যাই হোক প্রশাসন বলা যায় না। লুঠের রাজত্ব চলছে। তার ফলেই এই নৈরাজ্য এবং খুনোখুনি।” প্রবীণ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও অভিযোগ, “পুলিশ ও প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠী আর্থিক ফায়দা তোলার কাজ করছে। তার ফলেই এই পরিস্থিতি।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “যত দিন যাবে ততই তৃণমূলের উপরে তৃণমূলের এই আক্রমণ বাড়বে। পুলিশকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। আর পুলিশের কিছু বড় কর্তা শীর্ষ নেতৃত্বের সুনজরে থাকার জন্য নিচুতলার কর্মীদের অ্যাকশন নিতে বারণ করছেন। মুখ্যমন্ত্রী আবার এই অফিসারদের ধন্য ধন্য করছেন!”
শনিবার সামসুল হুদার তোলা ছবি।