—প্রতীকী ছবি।
মহালয়ার সকালে আকাশবাণীর কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং স্পর্শকাতরতা, দুটোই সবার জানা। সম্ভবত সেটা বুঝেই ইদানীং প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানের কোন সংস্করণটি সম্প্রচার করা হবে, তা জানিয়ে দেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। যেমন শুক্রবার বিকেলেই আকাশবাণী কলকাতার ফেসবুক পেজের ঘোষণা ছিল, এ বার ১৯৬৬ সালের রেকর্ডিং সম্প্রচার করা হবে। তখনই শ্রোতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়ে যায়।
২০২২ সালের পুজোয়, বহু বছর বাদে ১৯৬২ সালের রেকর্ডিং শুনেছিল বাঙালি। তাতে তরুণতর বয়সের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ তথা বাচিক অভিনয়ের দাপট কাকে বলে, টের পান শ্রোতারা। ১৯৬৬ সালের রেকর্ডিংটিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে ‘আশ্বিন শারদপ্রাতে’র চেনা ভাষ্য শুরু হচ্ছে একটু দেরিতে। তার আগে সংস্কৃত স্তোত্রের অংশ। ১৯৬২-তে গানগুলি এবং গানের শিল্পীরা একটু আলাদা ছিলেন। শ্রোতাদের একাংশের মধ্যে এই নিয়ে ক্ষোভও তৈরি হয়। আবার অনেক শ্রোতা চেনা শিল্পী, চেনা অনুষ্ঠানের মধ্যে নতুনত্বের আভাস পেয়ে খুশি হয়েছিলেন।
আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের কাছেও সম্প্রচারের জন্য অনুষ্ঠানের সংস্করণ বাছাই করা জটিল ধাঁধার মতো। আকাশবাণীর এক কর্তা বলেন, “১৯৭২-এ রেকর্ড ও সম্পাদনা করা যে অনুষ্ঠানটি বেশি জনপ্রিয়, তা তো ইউটিউবেও শোনা যায়! মহালয়ার সকালে শ্রোতাদের বেতার আর্কাইভের এক্সক্লুসিভ কিছু অনুষ্ঠান শোনানোর চেষ্টা করা হয়। তাই ১৯৬৬-এর রেকর্ডিংটি বেশ কয়েক বছর বাজানোর পরে গত বার ১৯৬২-এর অনুষ্ঠানটি বাজানো হয়েছিল।”
যদিও এক বার বাজিয়েই কেন ফের ১৯৬৬-এর অনুষ্ঠানে ফিরছে আকাশবাণী, তার কারণ জানা যায়নি। কেউ কেউ মনে করছেন, ১৯৬২-এর অনুষ্ঠানটি একটু আলাদা বলে কিছু শ্রোতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা মহালয়ার সকালে চিরাভ্যস্ত কয়েকটি চেনা গান শুনতে না পাওয়ার হতাশাকে কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ অনুষ্ঠানটি এখন একটি সৃষ্টিশীল অভিযাত্রা হিসেবে দেখেন গবেষকেরা। আকাশবাণীর ভাঁড়ারে আরও পুরনো রেকর্ডিং থাকার সম্ভাবনাও অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
আকাশবাণী কর্তৃপক্ষও যে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র ইতিহাস চর্চায় উৎসাহী, সম্প্রতি তার কিছু ইঙ্গিত মিলেছে। সম্প্রতি আকাশবাণীতে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী: একটি বিতর্কের সূত্রে’ বলে একটি সমীক্ষা শোনা যায়। তা লেখেন এবং পড়েন আকাশবাণীর প্রাক্তন আধিকারিক তথা বেতার বিষয়ক গবেষক ভবেশ দাশ। কয়েক বছর আগে নানা মহলে ছড়িয়ে পড়ে, অখণ্ড ভারতে এক বার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনুপস্থিতিতে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-র ভাষ্য, স্তোত্র পড়েন আকাশবাণী কলকাতার প্রথম মুসলিম ঘোষক নাজির আহমেদ (এই অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৩২ সালে)। নাজির পরবর্তী জীবনে ঢাকা রেডিয়োয় কৃতী শিল্পী, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক। নানা গুণের স্বাক্ষর রাখেন কলকাতার আকাশবাণীতেও। করতেন সংস্কৃত চর্চা। নীলিমা সান্যালের সঙ্গে রবীন্দ্র-কবিতা ‘কচ ও দেবযানী’ও করেন।
নির্ধারিত শিল্পী বীরেন ভদ্রের অনুপস্থিতিতে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র অনুষ্ঠানে নাজিরের পাঠের সূত্র হিসাবে ভবেশ নাজিরের ভাই নাট্যব্যক্তিত্ব সাঈদ আহমেদ, সাহিত্যিক শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকেদের স্মৃতিকথাকে খুঁজে পেয়েছেন। ভবেশ অবশ্য বলছেন, “এখনও নাজিরের এই পাঠের নিশ্চিত প্রমাণ নেই। তবে তা ফুৎকারে ওড়ানোর নয়। ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে এটা হতে পারে।”