বন্দিপুরে উদ্ধার হওয়া ডিম ফুটে জন্ম নেওয়া কেউটে শিশুরা। ছবি: কল্যাণময় দাস।
‘জাতসাপের’ শেষ রাখতে নেই। লকডাউনে বন্ধ নার্সারিতে বেড়ে ওঠা আগাছা সাফ করতে গিয়ে মা কেউটের মুখোমুখি হয়ে তাই দেরি করেননি শ্রমিকরা। কোদালের এক কোপে সাবাড় করে পোড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেন। কাজ একটু এগোতেই নতুন বিপত্তি। ঝোপের আড়ালে গর্তের ভিতর মা কেউটের পাড়া ডিম। ১৭টি।
গত ১১ অগস্ট হুগলির জাঙ্গিপাড়া ব্লকের রহিমপুরের ওই নার্সারির খবর পৌঁছয় স্থানীয় বন্যপ্রেমী সংগঠন ‘বন্দিপুর প্রকৃতি প্রেমিক সমিতি’র সদস্য কল্যাণময় দাসের কাছে। তিনি ঘটনাস্থলে হাজির হন। খবর যায় বনবিভাগের হাওড়া ডিভিশনের অন্তর্গত চুঁচুড়ার রেঞ্জার রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। কেউটের ডিমগুলি সংগ্রহ করেন তাঁরা। কল্যাণের কথায়, ‘‘আমার কাছে খবর আসে, মা সাপটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। গিয়ে দেখি ১৬টি ডিম তখনও অক্ষত। একটিতে চিড় ধরেছে। রেঞ্জার আমাকে বলেন, ডিমগুলি ফোটানোর চেষ্টা করতে হবে। তাঁর অনুমতিতে ডিমগুলি আমাদের সংগঠনের দফতরে নিয়ে আসি।’’
এরপর কলকাতার সর্প বিশারদ শুভ্রজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে শুরু হয় কৃত্রিম ভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কাজ। একটি প্লাস্টিকের পাত্রে ভিজে খড়, পচা পাতা, মাটি ও বালি দিয়ে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানেই রাখা হয় ডিমগুলি। ছত্রাক বা পোকামাকড় যাতে ডিম নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য চলে দিনভর পর্যবেক্ষণ। এক মাসের ধারাবাহিক পরিচর্যার পর গত সপ্তাহে ডিম ফুটে জন্ম নেয় ১৬টি কেউটেশাবক। কল্যাণ বলেন, ‘‘১১ সেপ্টেম্বর ভোররাতে প্রথম একটি ডিম ফুটতে দেখতে পাই। দুপুরের মধ্যে এক এক করে ১৬টি ডিমই ফোটে।’’ এক দিন পর্যবেক্ষণের পর হাওড়ার বিভাগীয় বনাধিকারিক (ডিএফও) রাজু দাসের নির্দেশে স্থানীয় ডিঙেভাঙা জলাভূমি লাগোয়া জংলা এলাকায় কেউটের বাচ্চাগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ডিম ফুটে বার হচ্ছে কেউটে ছানারা।
সর্প বিশারদ শুভ্রজ্যোতির কথায়, ‘‘কেউটের ডিম ফুটে বাচ্চা বার হতে সাধারণত ৫৫ থেকে ৬৫ দিন লাগে। এই সময়ে ইনকিউবেটরের ভিতর তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০ শতাংশের বেশি হওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজননের সময় কেউটেরা বর্ষা ঋতুকেই বেছে নেয়। কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে ইনকিউবেটর যন্ত্র ছাড়াও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে ডিম ফোটানো সম্ভব।’’ তবে দক্ষিণবঙ্গে এমন ঘটনার খুব বেশি নজির নেই বলেই জানাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন: ‘নিজেদের জীবন নিজেরা বাঁচান, প্রধানমন্ত্রী ময়ূর নিয়ে ব্যস্ত’, কটাক্ষ রাহুলের
বন দফতরের অফিসার রাজু বলেন, ‘‘আমাদের ডিভিশনে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। কেউটে ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ২ নম্বর তফসিল-ভুক্ত সংরক্ষিত প্রজাতি। তাদের মারা বা ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। ডিম ফুটিয়ে বাচ্চাগুলিকে প্রকৃতির কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে ভাল লাগছে।’’
আরও পড়ুন: পূর্ব মেদিনীপুরের পুকুরে তরাইয়ের কচ্ছপের বসত
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য জয়দীপ কুণ্ডু সোমবার বলেন, ‘‘হাওড়া বনবিভাগের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাঘরোল, সজারু, প্যাঙ্গোলিন-সহ নানা সংরক্ষিত প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাস। আগে সেখানে বন্যপ্রাণী মারার ঘটনা ঘটলেও বনবিভাগ এবং স্থানীয় কয়েকটি বন্যপ্রেমী সংগঠনের ধারাবাহিক প্রচারের ফলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।’’