দেবেন্দ্রনাথ রায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়কে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগে অনড় বিজেপি। এই অভিযোগে মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গে বন্ধ ডেকেছিল দল, রাষ্ট্রপতির কাছেও গিয়েছে। আর এ দিনই বিধায়কের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে পেয়েছে রাজ্য সরকার। তার পরেই নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সেই রিপোর্ট অনুযায়ী বিধায়ক সম্ভবত আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে করছে পুলিশ। মৃতের পকেটে থাকা চিরকুটে যে দু’জনের নাম পাওয়া গিয়েছিল, তাদের মধ্যে এক জন নিলয় সিংহকে এ দিনই সিআইডি আটক করেছে। আর এক জন মাবুদ আলির সন্ধানে তল্লাশি চলছে। পলাতক। গোটা ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব।
স্বরাষ্ট্রসচিব এ দিন বলেন, ‘‘বিধায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে জনচিত্তে উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়েছে। বিধায়কের দেহ ১৩ জুলাই ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। রায়গঞ্জ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না-তদন্ত হয়। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘাড়ে কালশিটে দাগের উল্লেখ রয়েছে এবং বাঁ হাতে চাপের ফলে তৈরি ক্ষতচিহ্ন দেখা গিয়েছে। এই ক্ষত ‘অ্যান্টি মর্টেম’ অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় গলায় ফাঁস লাগানো হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝোলার কারণে মৃত্যু হয়েছে। কেমিক্যাল এগজামিনেশনের পরে পরবর্তী রিপোর্ট পাওয়া যাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, অন্য পরিস্থিতিগত প্রমাণ, ব্যক্তিসমূহ এবং প্রমাণসমূহের তদন্ত চালিয়ে প্রাথমিক ভাবে রাজ্য পুলিশ অনুমান করছেন, ঘটনাটি সম্ভবত আত্মহত্যা।’’ ভবানী ভবন সূত্রের খবর, ময়না-তদন্তের চিকিৎসক জানান, গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু হয়েছে দেবেন্দ্রনাথের। বিধায়কের শরীরে কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবে তাঁর গলায় ১৫ ইঞ্চি লম্বা এবং আধ ইঞ্চি চওড়া ‘লিগেচার মার্ক’অর্থাৎ ফাঁসের দাগ মিলেছে। যা দেখে প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকরা পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই ফাঁসের দাগ টানা নয়। চিকিৎসার পরিভাষায় তাকে বলে‘নন কন্টিনিউয়াস’।
স্বরাষ্ট্রসচিব জানান, বিধায়কের শার্টের পকেটে একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছে। তাতে দু’জনের ছবি এবং মোবাইল নম্বর রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কেও প্রয়াত কিছু মন্তব্য করেছেন। আলাপনবাবু বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, এলাকায় স্থানীয় ভাষায় মিনি ব্যাঙ্কিং চলছে, প্যারা ব্যাঙ্কিংও বলা যেতে পারে বা টাকার নেওয়া-দেওয়া, সুদ ইত্যাদি ঘটনা ছিল। এই মিনিব্যাঙ্কিং-এর কী পরিপ্রেক্ষিত ঘটনার পিছনে কাজ করেছে বা করতে পারে, তা-ও রাজ্য পুলিশের তদন্তাধীন।’’
আরও পড়ুন: ফাটল একটাই, ক্ষতিপূরণের জন্য দাবিদার চার জন
সোমবার রাতে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী চাঁদিমা পুলিশের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁর দাবি, গত বছর দেবেন্দ্রনাথ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তাঁর আরও দাবি, মালদহের বাসিন্দা দুই ব্যক্তি মাবুদ আলি ও নিলয় সিংহের থেকে দেবেন্দ্রনাথ প্রচুর পরিমাণে টাকা পেতেন। দেবেন্দ্রনাথ অতীতে যত বার তাঁদের কাছে টাকা চাইতেন, তখনই তাঁরা বিধায়ককে হুমকি দিতেন। রায়গঞ্জ পুলিশ জেলার সুপার সুমিত কুমার বলেন, ‘‘টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করেই দেবেনবাবুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে।’’
রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর এলাকায় দেবেন্দ্রনাথের একটি বাড়ি রয়েছে। ছ’বছর আগে মালদহের ইংরেজবাজার এলাকার বাসিন্দা নিলয় সেই বাড়ির একটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। নিলয়ের সূত্রে মালদহের চাঁচল থানা এলাকার বাসিন্দা মাবুদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। দেবেন্দ্রনাথ রায়গঞ্জের মোহিনীগঞ্জ এলাকার একটি সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের পদে কর্মরত ছিলেন। সিআইডির দাবি, পাঁচ বছর আগে দেবেন্দ্রনাথ নিলয় ও মাবুদের সঙ্গে প্রোমোটারি ব্যবসা ও একটি চালকল খোলার সিদ্ধান্ত নেন। গোয়েন্দাদের দাবি, দেবেন্দ্রনাথ কয়েক দফায় বড় অঙ্কের টাকা দেন নিলয় ও মাবুদকে। সেই টাকা দেওয়ার জন্য তিনি নিজে বড় ঋণ নেন বলেও দাবি। সিআইডি-র অভিযোগ, সেই টাকা লোপাট করে দেয় নিলয় ও মামুদ। এই টাকা চাওয়া নিয়েই তাদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি হয় বলেও দাবি।
এই পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সমবায় ব্যাঙ্কের এক কোটিরও বেশি টাকা তছরুপের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। সিআইডির দাবি, এই অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথ গত বছর লোকসভা নির্বাচনের পর সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। সিআইডির এক কর্তার দাবি, কিছু দিন ধরেই নিলয় ও মাবুদের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল, তাই দেবেন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ঋণ শোধ করতে না পেরে দেবেন্দ্রনাথ অবসাদে ভুগছিলেন বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
সূত্রের খবর, সম্প্রতি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার অব কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ ওই সমবায় ব্যাঙ্কের সব অ্যাকাউন্ট যাচাই করে দেখেছে, মোট ৪ কোটি ৯৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৫৮৩ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল। ২ কোটি ৩৭ লক্ষ ১ হাজার ৬৫২ টাকা ঋণ হিসেবে ছিল। তবে ২ কোটি ৬০ লক্ষ ৫৯ হাজার ৯৩১ টাকার নথি পাওয়া যায়নি। যদিও হত্যার অভিযোগে সিবিআই তদন্ত চেয়ে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হয়েছে দল। তবে স্বরাষ্ট্রসচিব এ দিন বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্পষ্ট করে জানাচ্ছে, ঘটনার স্বচ্ছ এবং সম্পূর্ণ তদন্ত হবে। তদন্ত যুক্তিযুক্ত ভাবে শেষ পর্যন্ত করা হবে। তার জন্য সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক কারণে তদন্ত ব্যাহত হবে না।’’