টানা তিন মাস বরফের চাদরে ঢেকে থাকার পর ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেব-এ একটু প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে। জমে থাকা বরফ একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। গাছের ডালে ডালে পাখিদের আনাগোনা, বাড়ির উঠোনে দু’একটা চেনা মুখের উঁকিঝুঁকি, ধোঁয়াটে মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেবের উজ্জল হাসি— সব মিলিয়ে জানান দেয় শীত এখন শেষ বেলায় এসে পৌঁছেছে। মনে মনে প্ল্যান কষতে থাকি কাছাকাছি কোথাও দু’দিনের জন্যে বেড়াতে গেলে মন্দ হয় না!
বরফের চাদরে ঢাকা জাগ্রেব
পাশের দেশ বসনিয়া-র নাম শুনেছিলাম এখানে আসার আগেই। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলা বলকান যুদ্ধের শেষে পুরনো যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হয় ছ’টা স্বাধীন রাষ্ট্র— স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগভিনা, ম্যাসেডোনিয়া, মন্তেনিগ্রো ও সার্বিয়া। সেই ভয়ানক যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ— সারবিয়ান, ক্রোয়েট এবং মুসলিমরা ঘর ছাড়া হয়। নতুন গড়ে ওঠা ছֹ’টি দেশে এখনও তার ক্ষত চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে বলকান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দীর্ঘ দিন রাজত্ব করেছে অটোম্যান তুর্করা এবং তার পরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গারিয়ানরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুই হয়েছিল বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্দিনান্দ এবং তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত্যার ফলে। যে হেতু এক জন সার্ব ছিল ফার্দিনান্দের হত্যাকারী, অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে আক্রমণ করে এই অজুহাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও বলকানের ছিল বিশেষ ভূমিকা।
বসনিয়ার একটি ছোট্ট শহর জেনিৎসা, ওখানকার একটি স্টিল প্ল্যান্টে উচ্চপদে কর্মরত আমাদের এক বন্ধু আমন্ত্রণ জানালেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য। বসনিয়ান ভিসা জোগাড় করে আমার স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। জাগ্রেব থেকে জেনিৎসা মাত্র ৩৩৫ কিলোমিটার। কিন্তু বসনিয়ার দিকে রাস্তা মাত্র দু’লেনের হওয়ায় জন্য চার ঘণ্টার উপর সময় লাগে। তা ছাড়া সীমান্তের ঝামেলা তো আছেই।
স্লাভন্সকিব্রডে সীমান্ত পেরোবার পরেই চোখে পড়ল রাস্তার দু’ধারে ফাঁকা জমি-জঙ্গল এবং তার মধ্যে দু’ একটা করে ভাঙা ও পোড়া বাড়ি। পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর দেওয়ালে গুলির ক্ষতচিহ্ন, ভয়াবয় যুদ্ধের স্মৃতি আজও বহন করছে। লোকজন নেই বললেই চলে। বোঝা যায় যুদ্ধের সময় বাড়িঘর ছেড়ে পালাবার পর আর তারা ফিরে আসেনি। পুরো অঞ্চলটা এত ফাঁকা আর বিধ্বস্ত যে, দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। বেশ কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখতে পেলাম কিছু জনবসতি। বাড়ির উঠোনে মুরগির ঘোরাফেরা, রোদে দেওয়া জামাকাপড় যা দেখে মন কিছুটা স্বস্তি পায়।
যুদ্ধের বীভৎসতার সাক্ষী
একের পর এক গ্রাম ছাড়িয়ে চলেছি। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। স্পিড কখনও চল্লিশ তো কখনও ষাট। তার মধ্যেই নিপুণ দক্ষতায় এক জন আর এক জনকে ওভারটেক করে এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে কখন যে বসনা নদী আমাদের সঙ্গী হয়েছে বুঝতে পারিনি। নদীর কোল ঘেঁষে রেল লাইন। দু’দিকে উঁচু পাহাড়। শীতের প্রকোপ কমলেও হিমেল হাওয়া এখনও পাহাড়ের গায়ে সবুজের রং লাগতে দেয়নি— পাহাড়ের রং কোথাও বাদামি তো কোথাও কালো।
নদীর ধারে একটা ভাল জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করানো হল। জলের ধারে বেশ কিছু লোক বসে আছে ছিপ হাতে। একটা ছোট্ট গ্রাম। মধ্যিখানে একটা মসজিদ। এই অঞ্চলে জনসংখ্যার আশি ভাগই মুসলমান এবং তাই প্রায় প্রতিটি গ্রামেই একটা করে মসজিদ— যার গঠনশৈলীতে স্পষ্ট তুর্কি প্রভাব। রাস্তায় কিছু কিছু খ্রিস্টান গ্রামও পড়ল, তবে এদের গির্জায় কোনও বিশেষত্ব আমাদের চোখে পড়ল না।
পথে দেখলাম কিছু বন্ধ মোটেল— এখনও টুরিস্ট আসার সময় হয়নি। দু’একটা রেস্তোরাঁয় আস্ত ভেড়া শিকে গেঁথে রোস্ট করা হচ্ছে। নদী কখনও আমাদের বাঁয়ে, তো কখনও ডাইনে। দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর জেনিৎসায়। লোকসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার। স্টিল কারখানর চিমনির ধোঁয়া দেখে অনায়াসেই পৌঁছে গেলাম সেই বন্ধুর অফিসে। গুপ্ত সাহেব হাসি মুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ওঁর অফিসের আরও কয়েক জন ভারতীয়ের সঙ্গে আলাপ করে আমরা চললাম প্ল্যান্টের ভিতরটা দেখতে। আমাদের পরতে হল একটা করে জ্যাকেট, বুট, চশমা আর হেলমেট। গাড়ি করে মিনিট কয়েকের মধ্যেই একটা ছোট লোহার গেট দিয়ে ঢুকলাম মূল কারখানায়। লিফট করে উপরে উঠে প্রথমে কন্ট্রোলরুম আর তার পরেই সেই ফারনেস যেখানে আকরিক গলিয়ে লোহা হচ্ছে। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ভিতরে কী কাণ্ডটাই না চলছে! প্রচণ্ড গরমের তাত, যন্ত্রের শব্দ আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ এ দিক ও দিক ছিটকে উঠছে। তরল লোহা এবং খাদ আলাদা আলাদা চ্যানেল দিয়ে নিজের নিজের আধারে চলেছে। তারই মধ্যে বিশেষ ধরনের পোশাকে আপাদমস্তক ঢেকে কিছু লোক কাজ করছেন। কিছু ক্ষণ পর এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
স্টিল প্ল্যান্টের ভিতরে
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গুপ্ত সাহেবের বাড়ি। একটু জলপান করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সূর্যাস্ত হতে এখনও দেরি আছে— ফলে সামনের পাহাড়ের হাতছানিকে কী করে উপেক্ষা করি? গাড়ি নিয়ে আমরা গেলাম পাহাড়ের একেবারে মাথায়। একটা কাফে আর পাশে একটা টেনিস কোর্ট। পিকনিকের আইডিয়াল জায়গা। দিনের শেষ আলোয় দূরে শহরের ছবি অস্পষ্ট হয়ে আসছে, ও দিকে হাল্কা গোলাপি আকাশে তারাগুলো ফুটে উঠছে একটা একটা করে। চার দিক ভীষণ রকম নিস্তব্ধ! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগে। ঠান্ডা হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরায়। রাতের আলোয় নীচে জেনিৎসা হয়ে উঠেছে অপূর্ব সুন্দরী— চোখ সরানো যায় না।
পাহাড় চূড়ায় সন্ধে
ইতিহাসের সাক্ষী
পরের দিন আমরা বেরোলাম মস্তার ও আরও কয়েকটা জায়গা দেখার জন্য। সেই পাহাড়ি রাস্তা আর বসনা নদী চলল আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। পাহাড়ের পাথর আলগা হওয়ার কারণে বেশির ভাগ পাহাড় জাল দিয়ে ঢাকা। ড্রাইভার সঙ্গে থাকায় গুপ্ত সাহেব ও আমরা গল্প করতে করতে চলেছি। এসে পৌঁছলাম ইয়াবেলেনিতসায়। শহরটা নদীর ধারে। নদীর উপরের ভাঙা সেতুটা আজও ১৯৪৩ সালের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এখানে জার্মান সেনাদের রুখতে মার্শাল টিটোর পার্টিজানরা সেতুটা ধ্বংস করে। সেতুটা সেই অবস্থায় পড়ে আছে নদীর ভেতর— অন্য পাড়ে রেল ইঞ্জিনটা।
রাস্তায় বিশেষ কোনও উন্নয়নের কাজ চোখে পড়ল না। একটা কাফেতে একটু থেমে আবার পথে নেমে আসা। আকাশে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলা— তবে যেন মেঘের দলটাই বেশি ভারী। ঠিক হল মস্তারকে পাশ কাটিয়ে আমরা চলে যাব মেদুগোরিয়ে। এটা বিশ্ব জুড়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের একটি বিশেষ তীর্থস্থান। গল্পটা এই যে, ১৯৮১ সালের জুন মাসে পাঁচ জন শিশুর সামনে মা মেরি আবির্ভূতা হন। এবং সেই থেকে প্রতি মাসের ২ এবং ২৫ তারিখে ভর হয় দু’জনের উপর। আমাদের দেশের তীর্থস্থানগুলোর মতো এখানেও রাস্তার দু’ধারে ছোট ছোট দোকানে মেরি ও যিশুর নানা রকমের ছবি, জপের মালা আর নানা রকমের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি হচ্ছে। চার্চে লম্বা লাইন পড়েছে কনফেশনের। কনফেশন চেম্বারগুলোতে বিভিন্ন ভাষার নাম লেখা আছে— যাত্রীরা সেই মতো সেখানে ঢুকছে।
চার্চের পাশেই রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি যিশুর মূর্তি, পুনরুত্থান-এর ভঙ্গিমায়। কিন্তু এই মূর্তিটির মহিমা অন্যত্র। এর হাঁটুর কাছ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল অনবরত বের হতে থাকে। ভক্তরা সেই জল মুছে নেন ছোট ছোট কাপড়ে। আমিও একটু মাথায় লাগালাম ওই জল। মূর্তিটা জমাট ব্রোঞ্জের হলেও জল কোথা থেকে আসে বোঝা গেল না। এর বিজ্ঞান সম্মত কোন ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে। কিন্তু ভক্তের কাছে এটি একটি অলৌকিক ব্যাপার। যা হোক, হাজার হাজার মানুষের হাত ঘষায় মূর্তির ওই জায়গাটা প্রায় সোনার মতো চকচক করছে।
পুনরুত্থিত যিশু
পরের গন্তব্য মস্তার। কিন্তু তার আগে পেটে কিছু পড়া দরকার। মাছ খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই আমাদের ড্রাইভার সাহেব গাড়ি ছোটালেন। সরু, আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলেছি। পথে কত খাবারের দোকান চোখে পড়ল, কিন্তু সে সব জায়গায় না থেমে আমাদের গাড়ি চলল এক পাহাড়ি নদীর ধার দিয়ে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই এক অপূর্ব দৃশ্য— উঁচু পাহাড়ের নীচে এক গুহার মধ্য থেকে বেগে বেরিয়ে আসছে ফেনিল জলধারা। তারই এক ধারে, পথের একেবারে শেষ প্রান্তে চমৎকার একটা রেস্তোরাঁ। দরজার বাইরে একটা মাছ আঁকা, বোঝা গেল মাছই এদের প্রধান আইটেম। নদীর নাম বুনা। চওড়া বেশি নয়। একটা ছোট সেতু যোগ করেছে নদীর দু’ পাড় কে। এ পারে রেস্তোরাঁ— ও পারেও ছাতা লাগানো বসার জায়গা। একটু গরম পড়লেই খাবার জায়গা হবে ছাতাগুলোর তলায়। খাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার চমৎকার ব্যবস্থা! আমরা অবশ্য ভিতরেই বসলাম, কারণ এখনও ঠান্ডা রয়েছে। সুন্দর কাঠের ঘর— পুরনো আসবাব দিয়ে সাজানো। খাবার এল— রোস্টেড মাছ, আলু-সেদ্ধ, পালং শাক, পাউরুটি এবং স্যালাড। সঙ্গে অলিভ অয়েল। মাছটা খুবই স্বাদু। খাওয়া শেষ করে কিছু ছবি তোলা হল আশপাশের।
এ বার গাড়ি চলল বসনিয়ার অন্যতম শহর মস্তার-এর দিকে। ওখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য ‘ওল্ড ব্রিজ’ যার আসল নাম ‘স্তারি মোস্ত’। নেরেতভা নদীর ওপরে পাথরের এই সেতুটির বয়স চারশো বছরের বেশি— তৈরি হয়েছিল অটোম্যান তুর্ক রাজত্বের সময়। বর্তমান সেতুটা অবশ্য ১৯৯২-৯৫ সালের বসনিয়া যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধের পরে একে আবার গড়ে তোলা হয়েছে ঠিক আগের মতো করেই। এর বিশেষত্ব দেখলাম যে সেতুতে ওঠার জন্যে পাথরের সিঁড়ির ধাপ কাটা আছে। স্থাপত্যে তুর্কি ছাপ স্পষ্ট। সেতুতে ওঠা-নামার রাস্তার দু’পাশে দোকানিরা নানা রকমের ‘স্যুভেনির’-এর পসরা সাজিয়ে বসেছেন পর্যটকদের জন্য। দোকানগুলো ঘুরে দেখতে ভাল লাগে। একটু দরদাম করে দু’টো জিনিসও কিনে নিলাম। আর রয়েছে কয়েকটা কাফে ও রেস্তোরাঁ। একটু নজর করলেই চোখে পড়ে বেশ কিছু বাড়ির দেওয়ালে গুলির চিহ্ন।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, রাস্তা বেশ পিচ্ছিল। সময় নষ্ট না করে সকলে গাড়িতে গিয়ে বসি, অনেকটা পথ যেতে হবে।
ছবি: সন্দীপ পাল।
হাওড়ার মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে নানা দেশ ঘুরে আপাতত ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেবের বাসিন্দা। নানারকম রান্না করা ও বই পড়া ছাড়া বেড়ানোও একটা বিশেষ সখ।