স্রোতস্বিনী: নর্মদা এখানে দ্বিধাবিভক্ত
কথিত আছে, গঙ্গায় অবগাহনে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। কিন্তু নর্মদাকে দর্শনমাত্রই ঘটে পাপমুক্তি। তবে সে অভিপ্রায়ে নয়, রূপসী নর্মদাকে দেখতেই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ছুটেছিলাম জবলপুর। নাগপুর থেকে রাতের ট্রেনে। ট্রেনের জানালায় সূর্যোদয় দেখতে দেখতে পৌঁছলাম জবলপুর। স্টেশন থেকে ভেড়াঘাট প্রায় তিরিশ কিলোমিটার।
শহর হিসেবে জবলপুর বেশ প্রাচীন। ছিমছাম, পরিষ্কার ও সবুজে ভরা। রাস্তার দু’ধারে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা প্রান্তর চোখ জুড়িয়ে দেয়। ফাগুনের শুকনো পাতাঝরার দিনেও প্রকৃতি এখানে সবুজ! দু’পাশে উর্বর জমি, বিস্তীর্ণ শস্যখেত, ছোট বড় টিলা, বনানী, কোথাও নর্মদার থেকে পাহাড়ি পথ কেটে চলে আসা সরু জলস্রোত, দু’-চারটি বাড়িঘর নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম, কোথাও নিরালায় ঘন সবুজের মাঝে উঁকি দিচ্ছে কিছু রিসর্ট।
আমরা যে পথে চলেছি, এটি ভেড়াঘাটে যাওয়ার প্রচলিত রাস্তা নয়। আমরা যাচ্ছি নর্মদার অন্য ধার দিয়ে। এ রাস্তা নাগরিক জীবন, যানজট ও কোলাহল থেকে মুক্ত। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে পুঁজি করেই নর্মদার বিখ্যাত ধুয়াঁধার জলপ্রপাতের একেবারে ধার ঘেঁষে তৈরি হয়েছে আগামী দু’রাতের ঠিকানা।
স্থাপত্য: চৌষট যোগিনী মন্দির
সহস্র জলতরঙ্গের শব্দে চোখ ফেরাতেই নজরে এল ধুয়াঁধার জলপ্রপাত। দেখি, শ্বেতপাথরের উপরে প্রবল উচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়ছে পান্নারঙা নর্মদা। সেই শব্দেই দিগ্বিদিক মাতোয়ারা। আটানব্বই ফুট উঁচু থেকে পড়ায় সহস্রকোটি জলকণা বাতাসে মিশে সৃষ্টি করছে সাদা ধোঁয়া। সেজন্যই এর নাম ধূমাদার বা ধুয়াঁধার জলপ্রপাত। গর্জন, বর্ষণ, উচ্ছ্বাস এবং গতির সমন্বয়ে নর্মদার এই রূপ অবর্ণনীয়! ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ কথাটি বোধহয় এখানেই প্রযোজ্য। জলপ্রপাতের গুরুগম্ভীর সঙ্গীত শুনতে শুনতে, বসন্ত প্রভাতের শিরশিরে ঠান্ডায় ধূমায়িত চায়ে চুমুক দেওয়ার যে স্বর্গীয় অনুভূতি, তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।
এখান থেকে নর্মদার গতিপথ আক্ষরিক অর্থেই বন্ধুর, কঠিন ও প্রস্তরাকীর্ণ। জলপ্রপাত থেকে পাথরের বুক কেটে দু’টি ধারায় প্রবল বেগে ধাবিত হচ্ছে নর্মদা। কিছুটা দূরে গিয়ে সে শান্ত, সমাহিত, একই ধারায় লীন। তখন নর্মদার অন্য রূপ। দু’পাশে শ্বেত পাথরের খাড়া প্রাচীর, কোথাও তারা বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে নর্মদার জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে, কোথাও আবার দু’পাশের প্রাচীর একেবারে কাছাকাছি এসে সৃষ্টি করেছে ‘বান্দর কোদিনি’ পয়েন্ট (মার্বেল প্রাচীরের মাঝখানে এখানে নর্মদা এতটাই সরু যে, বাঁদরেরা লাফিয়েই পারাপার করতে পারে)।
উঁচু শ্বেতশুভ্র মার্বেল প্রাচীরের গায়ে সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক ভাস্কর্য ও শিল্পকলা দেখতে দেখতে নির্জন পথে নর্মদার গাঢ় সবুজ জলে নৌকাবিহারের অভিজ্ঞতা অনন্য। রাত্রে নৌকাবিহার বন্ধ থাকে। তবে মাসের একটি দিন, পূর্ণিমার রাতে পর্যটকদের জন্য মাঝিরা নর্মদার জলে নৌকা ভাসান।
ভেড়াঘাটে দর্শনীয় স্থান আরও আছে। জবলপুর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে চৌষট যোগিনী মন্দির, ভারতের প্রাচীনতম ঐতিহ্যশালী স্থানের একটি। অসংখ্য পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। পাহাড়চূড়ায় অনবদ্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সাক্ষ্য বহন করছে এই মন্দিরটি। এটির নির্মাণ দশম শতাব্দীতে। আরাধ্যদেবতা শিব ও দুর্গা হলেও, মূল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক ছোট ছোট যোগিনীর কক্ষ। নামে ‘চৌষট যোগিনী’ হলেও, সেখানে মোট একাশি যোগিনীর মূর্তি রয়েছে। সঙ্গে গণেশ, হনুমান ও অন্য দেবতারও মূর্তি। কক্ষসমূহ বৃত্তাকারে ঘিরে আছে মন্দিরটিকে। গর্ভগৃহে বিয়ের সাজে নন্দীর পিঠে শিব ও দুর্গার ব্যতিক্রমী মূর্তি আজও পূজিত হয়।
কাছাকাছির মধ্যে ঘুরে দেখা যায় জৈন মন্দির, একটি পুরনো কেল্লা, বার্গি ড্যাম ও ব্যালান্সিং রক। ভেরাঘাটের দূষণহীন রাতের আকাশে হিরের কুচির মতো সহস্রকোটি তারা দেখার অভিজ্ঞতাও অতুলনীয়। শহরের ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশে এ দৃশ্য তো বিরল।