এক দিকে পাহাড়ের সহজসরল মানুষের আতিথেয়তা, অন্য দিকে মেঘের সুবিশাল সাম্রাজ্যের আকর্ষণ
Arunachal Pradesh

মেঘরমণীর দেশ বমডিলা ও দিরাং

পাহাড়, নদী আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলতে ফেলতে ঠিক সন্ধের মুখে বমডিলা শহরে প্রবেশ করলাম। ৮৫০০ ফুট উচ্চতার বমডিলা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ ০৮:০৬
Share:

পাখির চোখে বমডিলা আপার মনাস্ট্রি

অনাঘ্রাত অরুণাচল। অরুণাচলের পশ্চিম প্রান্তেই সুন্দরী বমডিলা ও দিরাং উপত্যকা। অসম, অরুণাচল সীমান্তে অপরূপ ভালুকপংই এ রাজ্যের প্রবেশ পথ। এখানেই ইনার লাইন পারমিট দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করে পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়া। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দরী জিয়াভরলি নদী, পাহাড়ের উপরের উপজাতি মানুষ ভালবেসে যার নাম দিয়েছে কামেং। নামেরি অরণ্যের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে নাম না জানা নানা প্রজাতির অর্কিড আর বুনো কলাগাছ, অতিকায় বাঁশ গাছ আর রাক্ষুসে ফার্ন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। মাঝেমাঝেই পথ ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশায়। পাকদণ্ডী পথ ধরে শুধু উঠেই চলেছি। সবুজ প্রকৃতি তার আদিম সৌন্দর্য দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছে সকলকে। কখনও-কখনও পথ মেঘে এত ঢেকে যাচ্ছে যে সামনে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। আমরা চলেছি যে মেঘের রাজ্য বমডিলায়। এ পথেই পড়ে নাগ মন্দির ও রূপা ভ্যালি। আরও উপরে টেঙ্গা উপত্যকায় এক বিশাল সেনা ছাউনি রয়েছে। সেনাদের যাতায়াতের জন্য আমাদের মাঝেমাঝেই মিলিটারি কনভয়কে রাস্তা ছেড়ে দিতে হচ্ছিল।

Advertisement

পাহাড়, নদী আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলতে ফেলতে ঠিক সন্ধের মুখে বমডিলা শহরে প্রবেশ করলাম। ৮৫০০ ফুট উচ্চতার বমডিলা অরুণাচলের পশ্চিম কামেং জেলার সদর শহর। বেশ পরিষ্কার, সুন্দর সাজানো-গোছানো শহর বমডিলা। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে চিনা সেনারা বমডিলা শহরের দখল নিয়েছিল। রাতের আশ্রয় বমডিলা সরকারি টুরিস্ট লজে। আগে থেকে বুক করা লজের সুটটি সত্যি অনবদ্য। লজের মধ্যে ঘরের সামনে নানা রঙের গোলাপ ও অর্কিডের সুন্দর বাগান। ঘরের কাচের জানালা থেকেই সামনে সবুজ পাহাড় মাথায় বরফের মুকুট পড়ে হাতছানি দিচ্ছে। লজেই আলাপ হল অরুণাচলের সরকারি টুরিজম অফিসারের সঙ্গে। কথায়-কথায় ওখানকার সংস্কৃতির একটা আভাস পাওয়া গেল। টুরিস্ট লজের রাঁধুনি মেয়েটি মিজি সম্প্রদায় ভুক্ত। নাম সিরিং প্রেমা। সাদা টপ ও রঙিন লুঙ্গি তাঁর পরনে। গলায় লম্বা পুঁতি ও কাঠের মালা। কোমরে চকচকে পয়সার মতো ধাতব চাকতির কোমরবন্ধ। সদা হাস্যময় মঙ্গোলীয় চেহারার প্রেমাকে মনে থাকবে অনেকদিন।

পরদিন ভোরে উঠেই প্রথম গন্তব্য বমডিলা পাস। পাহাড়ে অজস্র স্ট্রবেরি ফলেছে নিজস্ব তাগিদেই। নীচে বমডিলা শহরের দৃশ্য এখান থেকে অসাধারণ। পরের গন্তব্য নতুন গুম্ফা বা আপার মনাস্ট্রি। ১৯৯৭ সালে দালাই লামা এই গুম্ফার উদ্বোধন করেছেন। বিশাল গুম্ফা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে । গুম্ফার মধ্যে শিশু লামারা ছুটে বেড়াচ্ছে। একটি ঘরে ছোট্ট ছোট্ট লামারা সুর করে পড়া মুখস্থ করছে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্য মুনি বুদ্ধদেবের বিশাল মূর্তি। একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্য পাশে গুরু রিংচেনপোর মূর্তি। সামনে কাঁসার সারি সারি বাটিতে পরিষ্কার জল নিবেদন করা আছে। সময় যেন এখানে থমকে রয়েছে যুগযুগান্ত ধরে। একটি কিশোর লামা আমাদের নিয়ে এল সারি সারি ধূপ নিবেদনের ঘরে। পুরনো ঘিয়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে বন্য ধূপের গন্ধ এক প্রাচীনত্বের আভাস দিচ্ছে। রহস্যময় অতীত যেন এখানে আধিভৌতিক ভাষায় ফিসফিস করে। রাশি রাশি প্রাচীন পুঁথির মধ্যে থরে থরে সাজানো এখানকার ইতিহাস। কোনওটা হাজার বছরের পুরনো, কোনওটা চারশো বছরের। সময় যেন বাঁধা পড়েছে এখানে যুগ যুগ ধরে।

Advertisement

নীচের বাজার এলাকায় পুরনো গুম্ফা বা থুবটেক গ্যালিং। সকালের নরম রোদে শিশু লামারা ছোটাছুটি করছে। ছবি তোলার কথা বলতেই গম্ভীর মুখে রাজি। সব দেখে টুরিস্ট লজে ফিরে প্রেমার হাতে তৈরি গরম-গরম খাবারে পাহাড়ি স্বাদ। রন্ধনে ও পরিবেশনে তা সত্যিই অতুলনীয়। এদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরাই অভিভাবক। ওঁর স্বামী ওঁদের ফুটফুটে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে এসে আমাদের দেখিয়ে নিয়ে গেল। পাহাড়ি জীবনের একটা ঝলক পাওয়া গেল।

দিরাং গুম্ফা

বমডিলা হল মেঘের স্বর্গরাজ্য। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে হলে আসতেই হবে বমডিলায়। মেঘরমণীর জলশরীরের স্পর্শ এখানে মনকে যেভাবে বিহ্বল করে বোধহয় আর কোনও শৈল শহরে তা হয় না।

পরদিন সকালে রওনা হলাম ‘ছোটা কাশ্মীর’ দিরাং-এর পথে । বৃষ্টির পরে চারদিক সোনা রোদে ভরে গিয়েছে। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট সাদা মেঘ। দূরে হাতছানি দিচ্ছে সিপিয়া রঙের পাহাড়। ভারী অপূর্ব সে দৃশ্য। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অপরূপ দিরাং নদী। বমডিলা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে দিরাং। নদীর ধারে ছবির মতো সুন্দর এই জনপদের উচ্চতা ৫৫০০ ফুট। উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে আপেল আর নাসপাতির বাগান। ১১ কিমি দূরে অপরূপ সাংতি উপত্যকা। দূষণ ও কোলাহলবর্জিত সাংতিতে নিজেদের ছাড়া আর কোনও পর্যটক খুঁজে পেলাম না। অনাবিল আকাশ, শুদ্ধ বাতাস, দৃপ্ত পাহাড় আর চঞ্চলা স্রোতস্বিনী যেন সৃষ্টির আদি থেকে আজও ডুবে আছে অফুরন্ত রূপের বিমুগ্ধ আধারে। ঋদ্ধ হলাম অনাঘ্রাত অরুণাচলের অনাবিল সৌন্দর্যে , স্মৃতির পাতায় যা ডাউনলোড করা থাকবে চিরকাল।

ভাস্কর বাগচী

ছবি: লেখক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement