পরিত্যক্ত: ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে আদি ধনুষকোডি
দুই পরিবারের ছ’জন মিলে চলেছি কন্যাকুমারী। চেন্নাইগামী ট্রেনে আড্ডা দিতে দিতেই উঠে এল রামেশ্বরমের কথা। সেতুবন্ধ রামেশ্বরম গল্পে পড়েছি। সীতাকে উদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র সাগরের উপরে সেতু নির্মাণ করে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছেছিলেন। আর সেখানে যাব না? সিদ্ধান্ত নিলাম, কন্যাকুমারীর আগে রামেশ্বরমেই যাওয়া যাক।
রামেশ্বরম ভারতের দক্ষিণ ভাগের প্রান্তিক স্থান। তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলার পুরসভা শহর। রামেশ্বরমের অবস্থান পাম্বান দ্বীপে ও মূল ভূখণ্ড থেকে পাম্বান চ্যানেল দ্বারা পৃথক। রামেশ্বরমই মূল ভূখণ্ডের সেই স্থান, যার সঙ্গে এক সময়ে সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কার যোগাযোগ ছিল। পক প্রণালী অতিক্রম করে জাহাজ যেত শ্রীলঙ্কার তলাইমান্নারে।
চেন্নাইয়ের এগমোর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। পরদিন পৌঁছে রামেশ্বরম মন্দিরের সামনে যখন গেলাম, তখন আলো ফুটছে। পুণ্যার্থীরা ভোরবেলাতেই পুজো দিতে এসেছেন। ভোর পাঁচটা থেকে স্ফটিক লিঙ্গ দর্শন শুরু হয়। মন্দিরে ঢুকতে গিয়েও আটকে গেলাম দোকানের সামনে। ভোরের কুয়াশায় গরম চা আর বড়া বিক্রি হচ্ছে। তা খেতে খেতে বাইরে থেকেই ভাল করে তাকালাম মন্দিরের দিকে। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিশালাকৃতি মন্দিরের চেহারাও স্পষ্ট হচ্ছে। বুঝলাম, রামেশ্বরমের যে কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া। শহরের মূল আকর্ষণ আরুলমিত্ত রামলিঙ্গেশ্বর বা রামনাথস্বামী মন্দির। সুবিশাল এলাকা জুড়ে দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি সেটি। বিশ্বের দীর্ঘতম অলিন্দ রয়েছে এই মন্দিরে। শোনা যায়, ব্রাহ্মণ রাবণ বধের পাপস্খলনের জন্য লঙ্কাজয়ের পরে এখানে পৌঁছেই শিবের পুজো করতে উদ্যোগী হন রাম। হনুমান যান শিবলিঙ্গ সংগ্রহে। তাঁর আসতে দেরি দেখে সীতা রামনাথলিঙ্গম গড়েন বালি দিয়ে। দু’টি মূর্তিরই পুজো করেন রাম। সেই অনুসারেই পরে মন্দিরটি গড়ে উঠে। মন্দিরের কাছেই সমুদ্র। পুণ্যার্থীরা সমুদ্রস্নান সেরে পুজো দেন। জায়গাটি অগ্নিতীর্থম নামেও পরিচিত।
চোখধাঁধানো: রামনাথস্বামী মন্দিরের অলিন্দ
রামেশ্বরমে সে রাত কাটালেও পরদিনের জন্য ছিল অধীর প্রতীক্ষা। এ বার আমাদের গন্তব্য ধনুষকোডি। রামেশ্বরম থেকে ধনুষকোডির দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার। এই প্রান্তভূমিতে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলন ঘটেছে ভারত মহাসাগরের। ডান দিকে মান্নার উপসাগর ও বাঁ দিকে পক প্রণালী। ধনুষকোডি থেকে ক’কিলোমিটার আগেই কোদণ্ড রামস্বামী মন্দির। সেখানে রয়েছে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, হনুমান ও বিভীষণের মূর্তি। কথিত, সেখানেই রামচন্দ্রের সঙ্গে বিভীষণের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।
ভাড়াগাড়িতে চেপে শুরু হল যাত্রা। এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে শুরু হল বালিয়াড়ি। প্রচণ্ড গরম। মাথার উপরে গনগনে সূর্য। স্থলভূমি সরু হয়ে আসছে তিরের ফলার মতো। রাস্তার দু’পাশে ছোট-বড় লেগুন। তার অগভীর জলে নানা পাখি। একদল ফ্লেমিঙ্গোও নজর এড়াল না।
গাড়ি এসে থামল ভূখণ্ডের ২০-৩০ ফুট আগে। সেখানে স্থলভূমি বড়জোর ৩০ ফুট চওড়া। যে দিকেই চোখ যায়, শুধু নীল সমুদ্র। আকাশ মেঘমুক্ত। মান্নার উপসাগরের জলের নীল দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এমন উজ্জ্বল অথচ গহিন নীল!
ওখানে সেই সময়ে পর্যটক বলতে জনা পনেরো। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন রামসেতুর কথা। ধ্বংসাবশেষটুকু দেখার আগ্রহও প্রকাশ করলেন অনেকে। রামসেতু তৈরি হয়েছিল বহু যুগ আগে। কথিত, লঙ্কা থেকে ফেরার পরে ধনুক দিয়ে সেতুটি ভেঙে দিয়েছিলেন রাম। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার জাফনা নিকটতম স্থলভূমি। ধনুষকোডি-জাফনার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। হাত বাড়ালেই শ্রীলঙ্কা!
যোগাযোগ: পাম্বান ব্রিজ
অসহ্য গরমে ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। সমুদ্রের জলে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসলাম গাড়িতে। আবারও এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে চলা শুরু। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি যেখানে থামল, সেই জায়গাটা দেখলে চমকে উঠতে হয়। ইতস্তত ছড়িয়ে ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি। বালির স্তূপের মাঝেই কোথাও উঠে আছে রেললাইনের অংশ। এই জায়গাটিই আদি ধনুষকোডি। এক সময়ে বড় জনপদ ছিল। পাম্বান থেকে রেলে যোগাযোগও ছিল। ১৯৬৪-র ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে রেললাইন বিচ্ছিন্ন হয়, পাম্বান-ধনুষকোডির ট্রেনে থাকা শ’দেড়েক যাত্রীর মৃত্যু হয়, আদি ধনুষকোডি থেকেও মুছে যায় প্রাণের স্পন্দন। পর্যটকেরা এখানে আসেন প্রকৃতির নির্মম তাণ্ডবলীলার শেষ চিহ্নটুকু চাক্ষুষ করতে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই ভগ্নাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে যেমন প্রকৃতির কাছে নিজের অসহায়তা প্রকট হয়ে ওঠে, তেমনই ধনুষকোডির রোমাঞ্চে গায়ে কাঁটা দেয়। পুরাণের গল্পকথার সঙ্গে মিলে যায় বাস্তব!