দুর্গরহস্য: অলওয়রের বিনয় বিলাস প্যালেস
ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সন্ধে নামবে কিছুক্ষণের মধ্যেই... ধীর গতিতে পাহাড়ি টিলার আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলেছে গাড়ি। আচমকা ব্রেক। সামনেই ময়ূরদম্পতি। প্রথম বৃষ্টিতে মনের আনন্দে সে কী নাচ তাদের! এমন অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা গেল না। অনাহূত অতিথির মুখোমুখি হয়ে লাজুক ময়ূরদম্পতি ঝটপট পাশের জঙ্গলে গা ঢাকা দিল। অগত্যা তাদের মনের ফ্রেমে বন্দি করে আরও উপরে উঠতে লাগলাম। পৌঁছলাম অলওয়রের এক হাভেলিতে। ব্যাকপ্যাক রেখে বাইরে আসতেই আকাশ জুড়ে সূর্যের শেষ রক্তিম রেখার চিহ্ন। দূরের জঙ্গল থেকে আসা পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আঁধার ঘনিয়ে এল।
যুদ্ধ, বীরত্ব আর রাজকীয়তার আর এক নাম অলওয়র। রাজস্থানের আনাচকানাচে আজও শোনা যায় অলওয়রের অজানা গল্প। কোনওটা আধিভৌতিক, কোনওটা সাহসিকতার, কোনওটা প্রেমের। সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের টানেই এখানে আসা। আরাবল্লী পাহাড়ে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর এই শহরের স্থাপত্য, ইতিহাস মুগ্ধ করে। প্রথম দিন গিয়েছিলাম বিনয় বিলাস মহল বা সিটি প্যালেসে। সরোবর ঘেরা বিশাল এলাকা জুড়ে মহারাজ বিনয় সিংহের এই প্রাসাদ। অসাধারণ কারুকাজ। শিশমহল, ডজনখানেক মন্দির, তিন হাজার ঘোড়ার আস্তাবল দেখার সঙ্গে কিছু ভৌতিক ঘটনার গল্প শুনে এগিয়ে চললাম অলওয়র মিউজ়িয়ামের দিকে। পাণ্ডুলিপি, মিনিয়েচার পেন্টিং, হাতির দাঁতের কাজ, রুপোর ডাইনিং টেবিল, হিরে কেটে তৈরি কাপ— বিলাসিতার রেশ রয়ে গিয়েছে আজও। মুঘল শাসকদের ব্যবহৃত অস্ত্রের সংগ্রহও দেখার মতো।
পরদিনের সফর নাতনি কা বারা। অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পেলাম রাজস্থানী খানা মির্চি বড়ার স্বাদ। সবুজ-লাল চাটনির সঙ্গে সে স্বাদ নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম কৃত্রিম হ্রদ শিলীশেড়ে। হ্রদের চারপাশে রাজা-রানির বিশ্রামাগার, সেখানে রাজার হালে পর্যটকদের রাত কাটানোর ব্যবস্থাও হয়েছে ইদানীং। আমাদের ভাগ্যে অবশ্য এ সুযোগটি ঘটেনি। তবে পাহাড়ে মোড়া, সবুজে ছাওয়া সরোবরের টলটলে জলে নিপাট জলভ্রমণ, কয়েক মুহূর্তে নিজেকে মহারানি মনে হয়েছিল বইকি!
অবগাহন: শিলীশেড় লেক
গন্তব্য তালিকায় না থাকলেও ফেরার পথে ড্রাইভারের উৎসাহে একটি গ্রাম্য পথে পৌঁছলাম। কেল্লা, বালি আর পাথরের বাইরে সে যেন এক অন্য রাজস্থান। ঢুকে পড়েছি সরিষ্কার অরণ্যে। এক সময়ে অলওয়র রাজাদের মৃগয়াভূমি ছিল এই জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যেই বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। গ্রামবাসীদের যাতায়াতের রাস্তাও জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। ফেরার সময়ে সেই পথে বেশ কয়েকটি সম্বরের দেখা মিলল। ঢেউখেলানো বনভূমিতে হুডখোলা জিপসিতে জঙ্গল সাফারির মজাই আলাদা। কিন্তু সাফারির প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। সাফারির চেনা ছকে না-ই বা হল বন্যপ্রাণীর দর্শন, জঙ্গলের সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ মন ভরিয়ে দিয়েছিল। জঙ্গলের মাঝে পাণ্ডুপোলে হনুমানজির মন্দির। গা ছমছমে পরিবেশে মন্দিরটি। আশেপাশের গ্রামের মানুষেরাই মন্দিরটি দেখাশোনা করেন। আর টিলার উপরে কাঙ্কওয়ারি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দ্রষ্টব্য।
টুকিটাকি
দিল্লি থেকে ট্রেনে বা বাসে তিন ঘণ্টায় ১৬৩ কিলোমিটার দূরে অলওয়র। শহর পরিক্রমার জন্য রাখুন তিনটি দিন। আবার সরিষ্কা থেকে অলওয়র না ফিরে সোজা যেতে পারেন ভরতপুর, দীগ বা অন্য পথে জয়পুর, অজমের
পরের দিনটা রাখা ছিল অলওয়র দুর্গের জন্য। কত শত বছরের ইতিহাস লালন করে আছে বালা কিলা বা অলওয়র দুর্গ। রাজপুতের ঐতিহ্য আর প্রকৃতির রহস্যময়তা এর শরিক। সিঁড়িহীন দুর্গের খাড়াই রাস্তা, গোটা অলওয়র শহরই দেখা যায় এখান থেকে। দুর্গের ভিতরে অন্ধকার করিডর, ফাঁকা অন্দরমহল, বিশাল আকৃতির রাজদরবার, আর বড় বড় জানালা ভূতুড়ে পরিবেশের হাতছানি দেয়। তার মায়া কাটিয়ে রমণীয় সূর্যাস্তের সাক্ষী হতে এলাম মুসিমহারানি কী ছত্রী। এখানেই সতী হয়েছিলেন রাজপুত রানি মুসি। তাঁর অশরীরী আত্মার গল্প আজও জড়িয়ে রয়েছে ছত্রীর প্রতি স্তম্ভে।
এ বার ফেরার পালা। রাতের আকাশে সে দিন ছিল হাজার তারার মেলা। পিছনে রাজকীয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রাজস্থানের সুন্দরতম দুর্গগুলোর একটি ঠায় দাঁড়িয়ে।