অপরূপ: কালো বালির সৈকত
গাড়ি থেকে নামার সময়ে শক্ত করে গাড়ির দরজাটা ধরে রাখা ভাল— এমন সাবধানবাণী প্রায়শই উড়ে আসছিল ইন্টারনেট, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে। কথাটা খানিক হেসে উড়িয়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিটা মালুম হল আইসল্যান্ডের রাস্তায় ঘোরার সময়ে, প্রতি পদে। এখানে হাওয়ার তেজ এতটাই বেশি, গাড়ি থেকে নেমে তক্ষুনি দরজা বন্ধ না করলে তা খুলে বেরিয়ে যেতে পারে হিঞ্জ থেকে!
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে সারাটা জীবন ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ-বিদেশের নগর-শহর-প্রান্তরে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণটা খানিক বেড়েই গিয়েছে। তাই শহর নয়, দুর্গম প্রকৃতি এখন টানে ঢের বেশি। সপরিবার আইসল্যান্ড বেড়াতে যাওয়ার পোকা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকের কাছ থেকে এসেছিল নিষেধাজ্ঞা। একে দুর্গম, তায় খরচটাও বেশ অনেক। তবু প্রকৃতি যখন ডাক দেয়, তখন সব ছেড়ে তার হাতছানিতে বেরিয়ে পড়াটাই দস্তুর। চিকিৎসক হওয়ার দরুন স্বাস্থ্যসচেতন ছিলামই। সঙ্গে চলেছে বছরভর পরিকল্পনা। আশ্চর্যের কথা, আমার ই-মেল মারফত সে দেশে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে, আইসল্যান্ড সরকার থেকে সে দেশ ভ্রমণের পুস্তিকা এসে পৌঁছল দ্রুত, তা-ও বিনামূল্যে।
আইসল্যান্ড ঘোরা মানে একটু-আধটু নয়, পুরো দেশটা ঘোরার ইচ্ছে ছিল। যাকে বলে ‘রিং রোড টুর’। দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু করে সারা দেশ গোল করে ঘুরে এসে ফের পৌঁছতে হবে শুরুর কেন্দ্রবিন্দুতেই। উড়ানগত সমস্যা ও বাধাবিপত্তির পরে রিখিয়াভিকে যখন পৌঁছলাম, কলকাতায় তখন মে মাসের ভ্যাপসা গরম। নির্দেশিকা মতো আগে থাকতেই ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম ওয়েদারপ্রুফ জ্যাকেট, বড় ভারী জুতো, পার্কা-সহ নানা জিনিস। এ দেশ থেকে সে দেশের তাপমাত্রার মারাত্মক বদল, চরম ক্লান্তিতে রিখিয়াভিকের প্রথম রাতটা কেটেছে অভুক্ত, পরিশ্রান্ত। এয়ারপোর্টে নেমেই নিয়ে নেওয়া হয়েছিল ব্লু কার রেন্টালে ঘোরার গাড়ি। দ্বিতীয় দিন ভিকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হল সেই গাড়িতেই। চালকের আসনে কখনও বন্ধু, কখনও ছেলে। ভিকে থামব পাঁচটি জায়গায়। থিঙ্গাভেলি ন্যাশনাল পার্ক যেন শিল্পীর পরম যত্নে আঁকা পেন্টিং। যেমন পাথুরে রুক্ষতা, তেমন সবুজের নানা সমারোহ। মাঝে একচিলতে নীলের মোহময় জলরাশি। এ দৃশ্য ক্যামেরায় নয়, ধরা থাকে মনের পর্দায়। স্ট্রোকুরগিজ়ার, সেলজাল্যান্ডসফসের রূপও তেমনই অপরূপ। স্কোগাফস জলপ্রপাতের শব্দে কান পাতা দায়। পরক্ষণেই মনে হবে, জলেরও কত শব্দ হতে পারে। কখনও মিঠে, কখনও রুক্ষ, কখনও প্রকৃতির আপন খেয়ালে বাজিয়ে দেওয়া জলতরঙ্গ। এ নিসর্গ উপভোগ করতে হবে নিঃশব্দে। কোনও কথা নয়, নয় ক্যামেরার আওয়াজও।
পরের দিনটাও ভিক ঘুরতে কেটে গেল। ছোট ভিক চার্চটি দেখার মতো। আলাদা করে বলতেই হয় ব্ল্যাক স্যান্ড বিচের কথা। সমুদ্রের সফেন জলরাশি এসে মিশছে যে তীরে, সেখানকার বালি শুধুই কালো। কালোর এত রূপও হয়! কোনও কিছুর সঙ্গেই সেই কালো বালির সমুদ্রতটের তুলনা বৃথা। আর সৈকতের শোভা বাড়াচ্ছে শত শত সিগাল।
পরদিন ছিল হফন যাত্রা। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ঘোরা। ক্লান্তি আর অবসাদ কেটে যায় তখনই, যখন জোকুলসারলন হিমবাহের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি নিজের ক্ষুদ্রতা নিয়ে। তুষারাবৃত প্রকৃতির সেই রূপ দেখার মতো। জোকুলসারলন আদতে হিমবাহে তৈরি লেগুন। জমাটবাঁধা হিমবাহে গাইড নিয়ে হেঁটেও আসা যায়। সাদা বরফের উপরে হালকা নীল আভা ও সূর্যের ঠিকরে পড়া আলো দেখলে মনে হয় স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানেই। একই রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম পরে, ভাটনায়োকুল ও স্নেফেলইয়োকুল হিমবাহ ঘুরে দেখার সময়ে।
রিং রোড টুরে আমরা মূলত ভাগ করে নিয়েছিলাম বেশ কিছু জায়গা— ভিক, হফন, এগিলস্তাদির, আকিউয়েরি, হুসাভিক, স্নেফেলনেস, রিখিয়াভিক। কোনও দিন ২০০ কিলোমিটার, তো কোনও দিন ৩৫০ কিলোমিটারের সফর। তীব্র হাওয়ার মাঝে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া, অবসন্ন ভাব ও প্রকৃতির কারণেই সব সময়ে সজাগ থাকা দরকার। তবু আইসল্যান্ড শত বাধার মাঝে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে পর্যটকদের জন্য। কোথাও পথের দু’পাশে সদ্য নেভানো উনুনের মতো ঝিমিয়ে পড়া আগ্নেয়গিরি, কোথাও পৃথিবীর সুন্দরতম কালো বালির সৈকত, কোথাও বা বহু বছরের পুরনো ইতিহাস আঁকড়ে থাকা লাইটহাউস। রয়েছে দৈত্যাকার ব্যাসল্ট রক, দেত্তিফসের মতো সুবিশাল জলপ্রপাত। এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ের মাঝে সুন্দর তৈরি করা সুড়ঙ্গ পেরোনোর পরে অনলাইনে টোল ট্যাক্স জমা দেওয়ার নিয়মটাও বড় ভাল ঠেকে। আর হুসাভিকে জিও থার্মাল স্পায়ের কথা না বললেই নয়। দূরে উত্তর মেরুর পাহাড়ের ঝলকানি, মাঝে নীল সমুদ্র। সেখান থেকে একটি বিশেষ অংশে জিও থার্মাল টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের জলকে করে তোলা হয়েছে উষ্ণ। নানা খনিজে ভরপুর সেই জলে গা ডুবিয়ে থাকলে নাকি কেটে যায় রোগবালাই। সেই জলে সওয়া এক ঘণ্টা ভেসে থাকার পরে মনেই হয়নি, সত্তরের বেশি বসন্ত পেরিয়ে এসেছি আমি!
সুমেরু বৃত্তাঞ্চলের বরফমোড়া রূপকথার রাজ্য ঘুরে দেখতে গিয়ে থাকে না সময়জ্ঞান। মনে হয়, যেন অন্য কোনও সময়ে, অন্য কোনও দেশে এসে পড়েছি। যেখানে নেই কোলাহল, ব্যস্ততা কিংবা মানবজীবনের ঠুনকো প্রতিযোগিতা। আর এখানেই মানুষকে অসহায় করে দিয়ে জয় হয় প্রকৃতির। এক বার নয়, দু’বার নয়, বারবার। প্রত্যেক বার।
ছবি: চিরাগ গঙ্গোপাধ্যায়, নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য