কু-উ-উ… ঝিক ঝিক শব্দে সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন চলে পাহাড়ি পথে। কোথাও পাশে চা-বাগান, কোথাও ছোট্ট স্টেশন। ট্রেন চলে দোকান-বাজার, গেরস্ত বাড়ির উঠোন ঘেঁষে। হাত নাড়ে কচিকাঁচার দল। টয় ট্রেন। নাম শুনলেই মাথায় আসে হিমালয়ের রানি দার্জিলিঙের কথা।
টয় ট্রেনের কথা উঠলেই মনে ভাসে অসংখ্য ছবি। ‘আরাধনা’ ছবির গান— ‘মেরে স্বপ্নো কি রানি কব আয়েগি তু…’। পাহাড়ি সড়কের গা ঘেঁষে রেলপথ। সে পথেই ছুটছে টয় ট্রেন। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরকে। পাশেই রাস্তা দিয়ে খোলা জিপে গাইতে গাইতে চলেছেন নায়ক রাজেশ খন্না।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে টয় ট্রেনের জন্ম। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত তার যাত্রাপথ। ১৮৮১ সালে প্রথম দার্জিলিং পর্যন্ত টয় ট্রেন ছুটেছিল। সেই টয় ট্রেনের কদর এখনও কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে জুড়েছে ভিস্তা ডোম কোচ। আধুনিক হয়েছে ট্রেন। পাশাপাশি, টয় ট্রেন ছুটছে ভারতেরও আরও কয়েকটি পাহাড়ি পথে।
ভারতে, দার্জিলিং ছাড়াও শিমলা, উটি, মাথেরন, পাঠানকোটেও টয় ট্রেন চলে। সে পথের আকর্ষণও বড় কম নয়। চার চাকার গাড়ির সঙ্গে টয় ট্রেনের গতি পাল্লা দিতে পারে না ঠিকই, তবে ভ্রমণপিপাসুরা যাত্রাপথের আনন্দটুকু প্রাণ ভরে নিতে চেপে বসেন টয় ট্রেনে।
শৈলশহর দার্জিলিঙের ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে টয় ট্রেন। জানা যায়, ১৮৭৮-এ এই রেললাইন বসানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতার ‘টম মিচেল অ্যান্ড র্যামসে কোম্পানি’কে। জামালপুরের ইআরআর ওয়ার্কশপে তৈরি হতে থাকে এই রেল টানার উপযুক্ত ছোট ইঞ্জিন। আকারে খুদে বলে তার নাম দেওয়া হয় ‘টাইনি’।
পাহা়ড়ি এই রেলপথের বিশেষত্ব আছে। কালকা থেকে শিমলা যাওয়ার পথে টয় ট্রেন ছোটে অসংখ্য ছোট-বড় সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। তবে দার্জিলিঙে লুপ আর জেড রিভার্সিং ব্যবহার করে সরীসৃপের মতো উঠেছে এই রেলপথ। পথের চড়াইকে সহজ করতে ১৯১৯ সালে তৈরি হয় বাতাসিয়া লুপ।
১৮৮০ সালের মার্চে ভাইসরয় লর্ড লিটনকে নিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে যাত্রা শুরু করে টয় ট্রেন। শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং পর্যন্ত রেলপথে যাত্রা শুরু সেই বছরেই। তবে ১৮৮১ সালে শিলিগুড়ি থেকে প্রথম দার্জিলিং পর্যন্ত টয় ট্রেন পৌঁছয়। এর পরের বছরেই রবীন্দ্রনাথ এতে চেপে দার্জিলিং গিয়েছিলেন।
১৮৮১ সালের ১৫ অগস্ট জন্ম ‘দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে কোম্পানি’র। এই সংস্থার তত্ত্বাবধানেই চলে টয় ট্রেন। ১৯৯৯-এর ২ ডিসেম্বর ইউনেস্কো দার্জিলিং থেকে ঘুম-এর মধ্যে চলা জয় রাইডকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়।
বিভিন্ন সময়ে প্রতিকূলতার মুখে পড়ে বন্ধ হয়েছে দার্জিলিঙের টয় ট্রেনের যাত্রা। কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও ধস, দুর্ঘটনা, অতিমারি ইত্যাদির জন্য মাঝেমধ্যেই থমকেছে ‘হেরিটেজ’ ট্রেনের পথ চলা। তবে, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে টয় ট্রেনের সফর।
২০২২ সালে দার্জিলিঙের টয় ট্রেনের মুকুটে জোড়ে নতুন পালক। চালু হয় ভিস্তা ডোম কোচ। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং কাচের জানলার আরামদায়ক কোচ নিয়ে ছোটে টয় ট্রেন। আসনে বসে প্রকৃতিকে আরও ভাল ভাবে উপভোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে ট্রেনটিতে। এই পথেই পড়ে উচ্চতম স্টেশন ঘুম।
কালকা-শিমলা: টয় ট্রেন সফরের আরও একটি পথ হল কালকা থেকে শিমলা। ৯৬ কিলোমিটার রেলপথে রয়েছে ১৮টি স্টেশন। এই ট্রেনযাত্রার রোমাঞ্চ আলো-আঁধারিতে। প্রায় শ’খানেক সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে রেলপথ। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আচমকা ট্রেন ঢুকে প়ড়ে লম্বা সুড়ঙ্গে। চারপাশে তখন অন্ধকার।
এই পথের সৌন্দর্য লুকিয়ে অনামী স্টেশনগুলিতে। মেঘের চাদর মাখা পরিচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্মগুলিতে মাথা দোলায় রঙিন ফুলের দল। সেই স্টেশনে নামা, আবার বাঁশি বাজলে ছুট্টে উঠে পড়ার আনন্দ ফিরিয়ে দেয় শৈশব।
১৯০৩ সালে কালকা-শিমলা রেলপথের সূচনা। হরিয়ানার কালকা থেকে হিমাচল প্রদেশের শিমলা পর্যন্ত ছোটে এই টয় ট্রেন। ২০০৮ সালে কালকা-শিমলা টয় ট্রেন ইউনেস্কোর ‘হেরিটজ’ তকমা পেয়েছে।
উটি-মেট্টুপালায়ম: সবুজ চা-বাগানের অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভাল উপায় উটি-মেট্টুপালায়মের টয় ট্রেন যাত্রা। নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ের অন্তর্গত ‘হেরটিজ’ টয় ট্রেনটি শুধু দেশ নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয়। নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে শুধু ভারতের নয়, এশিয়ার মধ্যেও অন্যতম খাড়াই রেলপথ হিসাবে পরিচিত।
১৯০৮ সালে এই রেলপথে প্রথম টয় ট্রেন ছোটে। তামিলনাড়ুর কোয়েম্বত্তুরের মেট্টুপালাইয়ম স্টেশন থেকে উধগমণ্ডলম, অর্থাৎ উটি স্টেশন পর্যন্ত এই ট্রেনের যাত্রাপথ। সাড়ে চার ঘণ্টার পথে কখনও সঙ্গ দেয় চা-বাগান, কখনও উপত্যকার দৃশ্য। পর্যটকেরা উটি থেকে কন্নুর বা কন্নুর থেকে উটি ফেরার জন্য বেছে নেন টয় ট্রেন।
নেরাল-মাথেরন টয় ট্রেন: মহারাষ্ট্রের শৈলশহর মাথেরন। টয় ট্রেনে বসে বর্ষায় সহ্যাদ্রি পর্বতের রূপ উপভোগের অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০ মিটার উচ্চতায় এই রেলপথ।
গরম থেকে মুক্তি পেতে ১৮৫০ সালে শৈলশহর মাথেরনকে আস্তানা করে ব্রিটিশেরা। নতুন করে শৈলশহর সাজাতে উদ্যোগী হয়। শোনা যায়, মুম্বইয়ের শিল্পপতি আদমজি পিরভয় ব্রিটিশ আধিকারিকদের খুশি করতে, যাত্রাপথ সহজ করতে টয় ট্রেন চালানোর উদ্যোগ নেন।
১৯০৭ সালে টয় ট্রেন চালু হয় মাথেরনে। ২১ কিলোমিটার পথ জুড়ে উপভোগ করা যায় ঘন সবুজ পাহাড়ি উপত্যকার দৃশ্য। টয় ট্রেনের যাত্রাপথে পড়ে নেরাল, জুমাপট্টি, আমন লজ, মাথেরন জনপদগুলি।
পাঠানকোট-যোগিন্দরনগর টয় ট্রেন: হিমাচল প্রদেশের আর এক প্রান্তেও টয় ট্রেন যাত্রা উপভোগ করা যায়।
১৯২৯ সালে এই ট্রেনযাত্রার সূচনা হয়। পথে ১৮টি স্টেশন রয়েছে। দীর্ঘ যাত্রাপথে শহর থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়ে ওঠার রোমাঞ্চ বেশ উপভোগ্য। এই ট্রেন নিয়ে অবশ্য নানা রকম গল্প রয়েছে।
অনেক বলেন, এই ট্রেন যাত্রায় কেউ কেউ ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন। একটি সমাধিস্থলের উপর দিয়ে রেলপথ নির্মিত হয়েছে বলেই বেশ কিছু ভৌতিক গল্প ভেসে বেড়ায় পাহাড়ি হাওয়ায়।