টেমি চা-বাগান।
মন খারাপ হলেই নাকি কুয়াশা হয়? মেঘাচ্ছন্ন দিনে নাকি মনটাও কেমন মুষড়ে থাকে? কিন্তু সেই মেঘ, সেই কুয়াশা যখন পাক খায় পাহাড়ি ঢালে বিস্তৃত নয়নাভিরাম চাবাগানের মধ্যে, তখন যে চোখজুড়নো সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তা দেখে মন আনন্দে নেচে ওঠে। ঠিক তেমনটাই ঘটল কিছু দিন আগে। দক্ষিণ সিকিমের বিখ্যাত টেমি টি-গার্ডেনে গিয়েছিলাম সম্প্রতি।
বৃষ্টিভেজা মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে গাড়ি দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে। চারপাশের শাল-সেগুনের ঘন জঙ্গল দেখলাম বারিধারায় সব মালিন্য ধুয়ে আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। তিস্তার প্রবল স্রোত, পাহাড়ের মধুর সান্নিধ্য, হরেক রঙের ফুল যাত্রাপথকে করে তুলল বৈচিত্র্যময়। মল্লি পৌঁছনোর আগে, রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে লাভার্স পয়েন্টে, যেখানে তিস্তা ও রঙ্গিত নদী দুর্বার প্রেমে একাকার। দ্রুতবেগে রংপোর বাংলা-সিকিম সীমানার প্রবেশতোরণ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সিংতাম। এখানে গ্যাংটকগামী রাস্তা ছেড়ে বাঁ হাতি চড়াই রাস্তায় ঢুকে পড়ল গাড়ি। তিস্তা এই পথ ধরেই বয়ে গিয়েছে উত্তর সিকিমের দিকে। খানিকটা পথ তিস্তাকে সঙ্গী করে, বাকিটা নির্জন চড়াই পথে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরিকে চোখে নিয়েই পৌঁছে গেলাম টেমি চা-বাগানে।
সিকিমের একমাত্র চা-বাগান (দেশের একমাত্র জৈব সারে উৎপাদিত চায়ের বাগানও বলা যেতে পারে) টেমি টি-গার্ডেনের মধ্যে অবস্থিত ১৩৫ বছরের পুরনো ব্রিটিশ আমলের টেমি বাংলোটির উপযুক্ত সংস্কারসাধন করে এ বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হল পর্যটকদের জন্য। কলকাতার প্রিয়া এন্টারটেনমেন্ট সংস্থার সঙ্গে সিকিম সরকারের পর্যটন বিভাগের পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট প্রজেক্ট) মডেলে চলবে এই উদ্যোগ। পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হল টেমি বাংলো ও পাশাপাশি অনেকটা অঞ্চল।
দিনান্তের মায়াবী আলোয় পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে বিস্তৃত ঘন সবুজ চা বাগান তার সৌন্দর্যের ডালি উজার করেই যেন স্বাগত জানালো অতিথিকে। পৌঁছেই দেখলাম টেমি বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে ‘কহানি’ সিনেমার সেই ভয়ঙ্কর ভিলেন ‘বব বিশ্বাস’। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন। ‘বব’ ওরফে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এসেছেন সস্ত্রীক। টেমির আকাশ মেঘলা হলেও টেমি চা-বাগান তখন নক্ষত্রখচিত। শাশ্বত তো আছেনই, এ ছাড়াও রয়েছেন সঙ্গীতজ্ঞ বিক্রম ঘোষ, অভিনেত্রী জয়া শীল (যিনি বিক্রমের সহধর্মিণীও বটে) ও আরও অনেকে।
১৮৮৫-তে তৈরি হয়েছিল এই টেমি বাংলো যার আগে নাম ছিল ‘বড়া বাংলো’। মূলত ব্রিটিশ মিশনারিরা থাকতেন এই দোতলা বাংলোটিতে। স্বাধীনতার পর মিশনারিরা ফিরে যান দেশে। তখন প্রথমে বনবিভাগের আধিকারিকরা ও পরবর্তীকালে চা-বাগানের ম্যানেজারদের আস্তানা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দর বাংলোটি। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাংলোটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। সেটিরই পুরনো রূপ আদ্যন্ত বজায় রেখে সংস্কারসাধন করে পরিবেশিত হয়েছে পর্যটকদের জন্য।
একান্তে জয়া শীল এবং বিক্রম ঘোষ
ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি, পুরনো ফায়ারপ্লেস, ঢালু ছাদে ফায়ারপ্লেসের চিমনি, সবই যেন সেই শতাধিক বছরের পুরনো সময়ের আমেজ এনে দেয়। বাংলোটির ঠিক সামনে দেখলাম রেলিং ঘেরা একটা জায়গা, যার নাম দেওয়া হয়েছে ডেক। নীচের ধাপের বাড়ির ছাদ আসলে এটি। ডেক-এ গিয়ে দাঁড়ালাম। উল্টো দিকের পাহাড়ের গায়ে তখন জ্বলে উঠেছে চুমকির মতো আলো। গ্রামের ঘরবাড়ির আলোগুলি অনেক দূর থেকে খুব ছোট ছোট দেখাচ্ছে। ঘন সাদা মেঘ নীচ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাহাড়গুলোর গায়ে যেন আলগোছে আটকে রয়েছে।
পর দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই আবার এলাম ডেক-এ। সকালে আবার অন্য রূপ সেখানকার। সবুজ চা-বাগান ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে অনেকটা নীচে। আরও বহু নীচে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে তিস্তা। সেখান থেকেই আবার উল্টো দিকের পাহাড়শ্রেণি সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলোর পিছন দিকটাতেও চা-বাগান ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে উপর দিকে। সবুজের কত রকমের শেড যে চোখে পড়ছে তা বলে বোঝানো যাবে না। বৃষ্টি ধোওয়া বলেই হয়তো রংটা আরও খোলতাই হয়েছে। টেমি বাংলোর ঘরগুলি ছাড়াও চা-বাগানের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও আটটি কটেজ নির্মিত হয়েছে।
সাতসকালে ডেক-এ ক্যামেরা কাঁধে হাজির শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন এ দিক-ও দিক। প্রচুর ফুলের গাছ রয়েছে গোটা চত্বরে। রয়েছে একটা মার্বেল ফলক, যাতে খোদিত আছে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে দ্বাদশ চোগিয়াল রাজা ও রানি চা গাছের দু’রকম চারা এখানে রোপণ করেন। একটা সালেমবং ও আর একটা টি-৭৮ প্রজাতির। ১০০ শতাংশ জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল ও আনাজের জন্য সিকিম শুধু ভারতেই নয়, গোটা বিশ্বেই এক অনন্য স্থান অধিকার করেছে। সম্প্রতি এই বিষয় ‘গ্রিন অস্কার’ পুরস্কারও পেয়েছে তারা।
প্রাতরাশ পর্বের পর বেরনো হল টেমি চা বাগানের কারখানাটি দেখার জন্য। টেমি বাংলো থেকে আঁকাবাঁকা চড়াই পথ ধরে গাড়ি চলল। পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। বেশ খানিকটা উপর থেকে টেমি বাংলো ও অন্য কটেজগুলিকে নিয়ে গোটা চা বাগানের এক অনবদ্য ছবি চোখে পড়ে। প্রায় ৫০০০ ফুট উচ্চতায় ঠান্ডাটা বেশ আরামদায়ক। বড় এই কারখানার বিভিন্ন ঘরে চলছে বিক্রয়যোগ্য চা পাতা বানানোর পদ্ধতি।
বায়োডাইভার্সিটি পার্কটির অবস্থান কারখানার কাছেই। এই পথেই দিনকয়েক আগে দেখা গিয়েছিল বিশাল এক ভালুক। মোবাইলে তোলা ভিডিও ছবি সাক্ষ্য দিল সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্যের। ব্লাড ফেজ্যান্ট পাখির দেখাও নাকি মেলে এই অঞ্চলে, এমনটাই শুনলাম। পার্কটি খুব একটা বড় নয়, কিন্তু বেশ সুন্দর। মখমলি ঘাসে ঢাকা পার্কে বেশ কিছু ওষধি গাছ রয়েছে যেগুলো থেকে নাকি অনেক কঠিন অসুখ সেরে যায়। ছোট একটা জলের কুণ্ডের উপর ছো়ট্ট কাঠের সাঁকোটা মন কেড়ে নেয় মুহূর্তেই। বাংলোয় ফিরে দ্রুত মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেড়িয়ে পড়া হল রাবাংলার দিকে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। টেমিতে আরামদায়ক আবহাওয়া থাকলেও, ৮০০০ ফুট উচ্চতার রাবাংলায় কিন্তু বেশ একটা শীত শীত ভাব টের পাওয়া গেল। সুদৃশ্য বুদ্ধ পার্ক দিয়েই শুরু হল রাবাংলা দর্শন। এর পর একে একে রালং গুম্ফা, হ্যান্ডিক্র্যাফটস সেন্টার ইত্যাদি দেখে আলো থাকতে থাকতেই ফিরে এলাম বাংলোয়।
ডেকে দাঁড়িয়ে ধূমায়িত চায়ের স্বাদ নিতে নিতে উপভোগ করছিলাম প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য। সাদা মেঘ ভাসতে ভাসতে ওড়নার মতো পেঁচিয়ে ধরছে কাছের সবুজ পাহাড় আর দূরের নীল পাহাড়কে।
টেমি বাংলোর একতলার বারান্দাটা বেশ বড়। বহু মানুষ একসঙ্গে আড্ডা দেওয়ার পক্ষে একেবারে আদর্শ। আর আমরাও সেটাকেই কাজে লাগালাম। দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর, জমজমাট আড্ডা শুরু হল লম্বা টানা সেই বারান্দায়। গল্প চলার ফাঁকেই চলে এল চিতল মাছের মুইঠ্যা, রডোডেনড্রন নির্যাস ও আরও নানা ধরনের আকর্ষণীয় আইটেম।
পর দিন প্রাতরাশের পর বেরনো হল নামচি দর্শনে। এখানেও পৌঁছে গেলাম আধ ঘণ্টার মধ্যেই। টেমির একটা অবস্থানগত সুবিধা আছে। এখান থেকে রাবাংলা, নামচি সবই খুব কাছে। দু-তিন দিন দিব্যি কেটে যায় এই সব সাইট সিয়িং করে। নামচি-র বিখ্যাত চারধাম, সামদ্রুপসের ১৩৫ ফুট উঁচু গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি, অভিনব তারেভির ইত্যাদি দেখে ফিরে আসতে দুপুর গড়াল। টেমিতে ‘অদ্যই শেষ রজনী’। পূর্ণিমায় শেষ রজনীর আড্ডাটাও হল ভালই। পূর্ণিমার মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে চরাচর। চা বাগান, কাছের ও দূরের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে ওড়নার মতো জড়িয়ে থাকা মেঘ— সব কিছু মিলেই যেন তৈরি করেছে এক মায়াময় জগৎ যা ছেড়ে আসতে মন চায় না।
খোশমেজাজে শাশ্বত এবং বিক্রম
কী ভাবে যাবেন:
বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে টেমির দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে টেমির দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। গাড়িতে যেতে সময় লাগবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। রিজার্ভ করলে ছোট গাড়ি (সুইফট, ইন্ডিগো ইত্যদি) নেবে ৩৫০০-৪০০০ টাকা, বড় গাড়ি (সুমো, স্করপিও, ইনোভা ইত্যাদি) নেবে ৪০০০-৪৫০০ টাকা। সাইটসিয়িং-এর ক্ষেত্রে গাড়ি ভাড়া পড়বে ৩০০০-৪০০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন:
টেমি বাংলো ও পার্শ্ববর্তী কটেজগুলিতে রাত্রিবসের সুবন্দোবস্ত আছে। দ্বিশয্যা ঘর ছাড়া স্যুইটও আছে।এ ছাড়া প্যাকেজের মাধ্যমেও (গাড়ি, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে) ঘোরার আয়োজন আছে। বুকিং: ৯৮৩০১৬৯৬৯৪, ৯৮৩১০৯৭৯৪৫
ইমেল: reservstion@
ওয়েবসাইট: www.ecoadventureresorts.com