দূরে অযোধ্যা পাহাড়। ছবি: সুজিত মাহাতো
আমরা যাঁরা পাহাড়ের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারি না, তাঁরা সুযোগ পেলেই ছুটে যাই পাহাড়ের কাছে। হাতে দিন দুয়েক ছুটি পেলেও পাহাড়ের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। এই পাহাড়-প্রেম আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই। আজ এই মধ্যবয়সে এসেও পাহাড়ের প্রতি অমোঘ টান আমার বেড়েছে বই কমেনি।
বন্ধু মহলে আমি তাই এক্কেবারে পাহাড় প্রেমিকা নামে ভূষিতা হয়েছি। মিথ্যে বলব না, আমারও কিন্তু বেশ লাগে এই নামখানি।
এই বছর শীতে মেয়ের স্কুলে ছুটি পড়ার আগেই মনস্থির করে রেখেছিলাম। ডিসেম্বরে এ বার পাড়ি দেব পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে। এই সংক্রান্ত কিছু তথ্য জোগাড় করেছিলাম বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে। আর বাকিটা গুগলের কৃপায়।
ব্যাস আর কি! যেমন ভাবা তেমন কাজ। ২১ ডিসেম্বর সকাল আটটা নাগাদ বর্ধমান থেকে গাড়িতে সপরিবার বেরিয়ে পড়লাম পুরুলিয়ার উদ্দেশে।
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল দু’নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। বর্ধমান থেকে কিছু দূরে পানাগড়ের দার্জিলিং মোড়ের কাছে একটি হোটেলে গরম গরম লুচি, তরকারি আর ঘন দুধের চা দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। কিছু দূর যাওয়ার পরে দুর্গাপুর ব্যারাজ পেরিয়ে বাঁকুড়ায় ঢুকে পড়লাম। এ বার সোজা পুরুলিয়ার পথ ধরল আমাদের গাড়ি ।
দু’দিকে একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছিল লালমাটির কত অজানা অচেনা গ্রাম। আমার হাত নিশপিশ করে উঠল। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে পটাপট কিছু ছবি লেন্সবন্দি করে ফেললাম।
বেলা একটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম শহর পুরুলিয়ায়। সেখানে প্রথমেই দেখলাম সাহেব বাঁধ। বিশাল জলাধার আর তাকে ঘিরে রয়েছে চওড়া পিচের রাস্তা। আর উল্টো দিকে সুন্দর করে সাজানো একটি পার্ক। এই বাঁধে অজস্র পরিযায়ী পাখিদের ভিড় চোখে পড়ল। নানা রঙের পাখির মেলা চোখ জুড়িয়ে দিল। সাহেব বাঁধের বাঁধানো চওড়া সিঁড়িতে, ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়ায় একটু জিরিয়ে নেওয়ার পরে পুরুলিয়া শহরের ভিড় কাটিয়ে গাড়ি চলল অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। চললাম আমরা পাকদণ্ডি পথে অযোধ্যার অজানা সৌন্দর্যের সন্ধানে।
প্রায় দেড় ঘন্টা পরে আমরা অযোধ্যার উপরে আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম। দুপুরে স্নান,খাওয়া সেরে সময় নষ্ট না করে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে। এ বার পাহাড়ি পথে এঁকেবেঁকে পৌঁছলাম বামনি ফলসের দোরগোড়ায়। সেখানে প্রায় চারশো সিঁড়ি ভেঙে নামলাম একেবারে নীচে। নামার পথের দু’পাশে তৈরি রয়েছে অনেক অস্থায়ী দোকানপাট। চা, কফি, ঠান্ডা পানীয়, টুকটাক জিনিসপত্র কি না বিক্রি হচ্ছিল সেখানে।
অনেক উপর থেকে বড় বড় পাথরের বুক চিরে নেমে আসছিল বামনি ফলসের ধারা। অপূর্ব সেই দৃশ্য। সেখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পরে হোটেলে ফেরার পথে দেখলাম মার্বেল রক। বিশাল বিশাল পাথরের মাঝে এক টুকরো লেক। কোথাও যেন সিকিমের গুরুদংমার লেকের সঙ্গে মিল রয়েছে। গুরুদংমারে চারপাশে বরফ জমে থাকত। আর এখানে নেড়া পাথর দেখা যাচ্ছে। মার্বেল রকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সময়ের খেয়াল ছিল না আমাদের। কখন যে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। জমাট বাঁধা অন্ধকার পথ ধরে ফিরে এলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়লাম গরম কম্বলের তলায়। কী দেখলাম আর আগামীকাল কী দেখব এই সব ভাবতে ভাবতে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল থেকে ঠিক করে দেওয়া এক গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পথের দু’পাশে শাল গাছের জঙ্গল। এই পথ ধরে এগিয়ে চললাম অযোধ্যা থেকে বাঘমুণ্ডির দিকে। ছবির মতো এই পথ ধরে যেতে যেতে বারে বারে চোখ আটকে গেল সবার অলক্ষে, অযত্নে বেড়ে ওঠা রঙবেরঙের জংলি ফুলের সৌন্দর্যে। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ল স্বর্ণলতার মোহময়ী রূপ।
ঘণ্টা দেড়েক পরে আমরা নামলাম মুরুগুমা বাঁধের কাছে। পথে দেখলাম ময়ূর পাহাড়। এর পরে কিছু দূর এগিয়ে পৌঁছলাম পাহাড়ের উপরে একটি ভিউ পয়েন্টে । সেখান থেকে মুরুগুমা বাঁধ এবং তার আশপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এর পরে আমরা দেখলাম খয়রাবাড়ি বাঁধ, যা এক কথায় অসাধারণ। পাহাড় ঘেরা এই বাঁধ দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য।
শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে বেশ কিছু সময় সেখানে ঘুরে আমরা ফিরে চললাম। দুপুরে বাঘমুণ্ডি বাজারে একটি ছিমছাম হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম কাছের চরিদা গ্রামে। পুরুলিয়ার সম্পদ ছৌ নাচ। দেশে, বিদেশে এ নাচ সমান ভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত। সেই ছৌ নাচে ব্যবহৃত মুখোশ তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ এই চরিদা গ্রাম। এই গ্রামে প্রায় সব ঘরে মুখোশ তৈরির কাজ চলে। বড়দের পাশাপাশি মুখোশের গায়ে পুঁতি, চুমকি বসানোর কাজে ব্যস্ত ছোটরাও। অযোধ্যার স্মৃতি হিসেবে পছন্দসই কয়েকটি মুখোশ কিনে ফেললাম।
চরিদা গ্রামকে পিছনে ফেলে গাড়ি চলতে লাগল আপার ড্যাম এবং লোয়ার ড্যামের দিকে। বলতে দ্বিধা নেই পাহাড়ের উপরে আপার ড্যামের সৌন্দর্য যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। বোল্ডারে বাঁধানো বিশাল জলাশয়। যত দূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। দূরে আবছা পাহাড়। শান্ত জলরাশি। চারপাশ চুপচাপ, নিস্তব্ধ। জলের উপরে চওড়া সেতু ছুঁয়েছে জলের একপ্রান্ত। আমাদের অযোধ্যা ভ্রমণ এখানেই শেষ হলে কোনও দুঃখ থাকত না। কিন্তু এর পরে একটা দারুণ চমক অপেক্ষা করছিল। সে দিন রাতে আমাদের হোটেল সংলগ্ন একটা ছোট্ট মাঠে স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে বসল ছৌ নাচের আসর, মহিষাসুরমর্দিনী পালা। খোলা আকাশের নীচে হাড় কাঁপানো ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম কী অসম্ভব অধ্যবসায় থাকলে তবেই এমন নাচ সম্ভব।
পরের দিন বাড়ি ফেরার পালা। সকালে হোটেলের পিছনে দিকে সবুজ নরম ঘাস আর দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উপলব্ধি করলাম এই দু’দিনেই আমি অযোধ্যার প্রেমে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছি।