দাওয়াইপানি গ্রাম।
দাওয়াইপানি গ্রামটার নাম শুনে মজার মেজাজেই মনে হল, সেখানকার জলে হয়তো দাওয়াই বা ওষুধ গোলা আছে। পান করলেই সব খাবার হজম হয়, রোগ সেরে যায়। এত দিনে তবে বাঙালির পশ্চিমে হাওয়া বদলের বিকল্প জায়গার খোঁজ মিলল উত্তরবঙ্গে! এমনিই ভাবা, গিয়ে শুনি সেটাই সত্যি এবং গল্পটির উৎস সেই ব্রিটিশ আমলে, যখন সাগরপারের গোরাদের প্রিয় কুইন অব হিলস ছিল দার্জিলিং শৈলনিবাস।
দার্জিলিং ম্যাল থেকে পশ্চিমের পাহাড়ে চোখ মেলে দিলে সবুজের সাম্রাজ্যের মাঝখানে মুখ লুকিয়ে দাওয়াইপানি গ্রাম। গাড়ির রাস্তা অনেকটা ঘুরে গেলেও আকাশপথে উড়ে যাওয়া সম্ভব হলে দু’জায়গার দূরত্ব মাত্র ৪ কিমি। এক-দেড় বছর হল পরিচিতির আলো পেয়েছে। দার্জিলিংয়ের ঠিক বিপরীতে দাওয়াইপানি হওয়ায় এ গ্রাম থেকে শৈলশহরের দৃশ্য বিমুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে হয়। প্রায় ৬ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে দিনের বেলায় দার্জিলিংকে দেখলে মনে হবে, গিরিশিরায় অগণিত ফুল ফুটে আছে। খুঁতখুঁতে মন হলে, কংক্রিটের জঙ্গল ভাবতেও পারেন। তবে অন্ধকার নামার পর সকলেরই ভাল লাগবে দূরের দার্জিলিং।
গিরিশিরা জুড়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের আশ্চর্য সুন্দর অকাল দেওয়ালি। এখানেই শেষ নয়, আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তবে তো দাওয়াইপানি তুলনাহীন। দিগন্তে ঝকঝক করে কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত হিমালয়ের অনেকগুলি বরফচূড়া। ডিসেম্বরের শেষে ঝকঝকে মেঘহীন দিনে আমরা ২৪ ঘণ্টাই তুষাররাজ্য দেখেছি। বস্তুত, দার্জিলিংয়ের আকাশে বরফাবৃত হিমালয়ের এমন বিস্তীর্ণ অংশ দেখা যায় না৷ নেপাল থেকে ভুটান হিমালয়ের সব নামজাদা শৃঙ্গ এক ফ্রেমে। তার নীচের পাহাড়ে সিকিমের জোড়থাং ও নামচি শহর এবং বিস্তীর্ণ পার্বত্য গ্রামাঞ্চল। সূর্যোদয়ের রঙে যেমন অপরূপ লাগে বরফের পাহাড়গুলিকে, তেমনই সূর্যাস্তের কমলা আলো এক অপার্থিব মায়ার পরিবেশ তৈরি করে।
দাওয়াইপানি গ্রামে গাড়ি চলার একমাত্র রাস্তা।
সত্যিই লাবণ্যময় প্রকৃতি দাওয়াইপানি গ্রামে। পাহাড়ের অনেকটা দূর পর্যন্ত যেন গড়িয়ে নেমে গিয়েছে গাড়ি চলার একমাত্র রাস্তা। একের পর এক হাড় হিম করা হেয়ারপিন বেন্ড নয়াবস্তি থেকে পুরানাবস্তি পর্যন্ত। এই রাস্তার ধারেই যাবতীয় বাড়িঘর, প্রাইমারি স্কুল ইত্যাদি। নীচের দিকে ধাপে ধাপে চাষের জমি। ইতিউতি ঝাড়ু গাছের ঝোপ। গ্রামের পাকদণ্ডী বেয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ানো আর দু’চোখ ভরে নিসর্গের রূপ দেখা ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই দাওয়াইপানিতে।
সবুজের সাম্রাজ্যের মাঝখানে মুখ লুকিয়ে দাওয়াইপানি গ্রাম।
ব্যস্ত ঘোরাঘুরি নয়, চুপচাপ নির্জনে প্রকৃতির রূপসুধা পানে মন হলে দাওয়াইপানি চলে যান। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যে রংবাহারি শোভা দেখবেন বরফাবৃত হিমালয়ের বুকে, তা সহজে ভুলতে পারবেন না। সম্প্রতি অনেকগুলি হোম স্টে তৈরি হয়েছে মূল রাস্তার গায়ে। সবগুলি থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। পুরো দাওয়াইপানি গ্রামটাই যেন ভিউপয়েন্ট। দার্জিলিংয়ের মতো রাত থাকতে উঠে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে টাইগার হিলে যাওয়ার কোনও দরকার নেই, এখানে কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিলেই হল। বাকি দিন সকাল থেকে সন্ধে গ্রামের মানুষের সহজ সরল মিশুকে স্বভাব ও তুলনাহীন অতিথিপরায়ণ মনের পরিচয় পেয়ে ভ্রমণ অন্য মাধুর্যে ভরে উঠবে। হিমালয়ের চেনা-অচেনা পাখি দেখায় মন হলে তো সোনায় সোহাগা। কয়েকটি মনোরম নেচার ট্রেল রয়েছে গ্রামের আশেপাশে। নিরাপদ পার্বত্য অরণ্য প্রকৃতিপড়ুয়ার মুক্ত পাঠশালা। হোম স্টে-র সদস্যরাই আধবেলার পদযাত্রায় আপনার গাইড হবেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত হিমালয়ের বরফচূড়া।
দাওয়াইপানি থেকে গাড়িতে এক দিন বেড়িয়ে আসতে পারেন লামাহাট্টা পার্ক। দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি। সাজানো পরিবেশ কতটা মনে ধরবে, সে গ্যারান্টি অবশ্য দিতে পারি না। তবে চলার পথে পেশক রোডের চিরনতুন সৌন্দর্য তো নজর কাড়বেই। দাওয়াইপানি থেকে সারা দিনের জন্য গাড়িতে মাত্র ২০ কিমি দূরবর্তী দার্জিলিং বেড়িয়ে আসতেও কোনও অসুবিধা নেই। গ্রামে থেকে শহর দেখা ভ্রমণে এক মধুর স্বাদ বদল নিয়ে আসবে।
আরও পড়ুন: গল্পের বাঘ করবেটে টানে
কী ভাবে যাবেন: এনজেপি বা শিলিগুড়ি থেকে কম-বেশি ৮০ কিমি দূরে দাওয়াইপানি গ্রাম। জোড়বাংলো বা ঘুম পর্যন্ত শেয়ার গাড়িতে গিয়ে বাকি পথ গাড়ি ভাড়া করে পেশক রোড হয়ে পৌঁছে যেতে পারবেন। শেয়ারের ভাড়া জনপ্রতি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। আর পুরো গাড়ি ভাড়া করলে পড়বে ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকা। তিন মাইল বাজার অতিক্রম করে বাঁ দিকের রাস্তায় ২ কিমি। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব মাত্র ২০ কিমি।
আরও পড়ুন: এশিয়ার স্নিগ্ধ সমুদ্রসৈকত প্রত্যক্ষ করতে চাইলে ইন্দোনেশিয়ার বালি সেরা বাছাই
কোথায় থাকবেন: ‘হামরো হোম’ হোম স্টে। এখানে দুজনের থাকা-খাওয়ার খরচ ন্যূনতম ৩১০০ টাকা। এর সঙ্গে জিএসটি জুড়বে। কলকাতা বুকিংয়ের ফোন: (০৩৩)২৫৫৫-০২৬২, ২৪৩০ ৪৬৪১, বীরেনস হোম স্টে, ফোন: ৯৬৪১৪৫২৭১৮, রোভার্স স্টে, ফোন: ৯০০৭১৩৮৫০৪, সিদ্ধার্থ হোম স্টে, ফোন: ৭৭৯৭৪৪৪৫৩৫। প্রতিটি জায়গাতেই দু’জনের থাকা-খাওয়ার খরচ কমবেশি ২৪০০-২৮০০ টাকা।
ছবি: লেখক