শিমলা।
ছবি আঁকা এক শৈলশহর। আদ্যোপান্ত ব্রিটিশদের হাতে গড়া। পাইন আর ধুপির ছায়ার মোড়া। কালকা থেকে চলে আসুন খেলনা রেলে। ধুপি, পাইন আর টানেলের রোমাঞ্চকর আলোছায়া মাখা পথের শোভা মুগ্ধ করে দেবে। শিশু রেলের নস্টালজিক সফর অনবদ্য। শিমলা ও তার আশপাশ দেখতে হাতে দু’দিন সময় রাখুন।
দেখে নিন
মিথ বলছে, শ্যামলাদেবীর নাম থেকেই শিমলার নামকরণ হয়েছে। এই পাহাড়ি শৈলশহরের ইতিহাস জানতে হলে অবশ্যই দেখে নিন শিমলা মিউজিয়াম। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। ব্রিটিশরা, পরিকল্পনামাফিক এই শহরকে বানিয়েছিলেন।
প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায় এক শৈলশহর। কালকা হয়ে গোটা যাত্রাপথে আপনার সঙ্গী শুধুই মুগ্ধতা। চলে আসা যায় গাড়িতেও। চণ্ডীগড় থেকেও আসা যায়। সময় নেবে সাড়ে চার ঘণ্টা। অজস্র দোকানপাট, রেস্তরাঁ, হোটেল আর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। শিমলার মূল আকর্ষণ ম্যাল। পর্যটকদের ভিড়ে মাঝে শেষ প্রান্তে আংলেশিয়ান ক্রাইস্ট চার্চ। হলদেরঙা এই গির্জাটি ১৮৪৪-’৫৭ সালে তৈরি হয়েছিল, নিয়ো-গথিকশৈলীতে। প্রতি সন্ধ্যেয় অপরূপ আলোকমালায় সেজে ওঠে। চলে আসুন শিমলা কালীবাড়িতে। ডান দিকে মঙ্গলচণ্ডী আর বামে শ্যামলাদেবী। দেখে নিন, হিমেল হাওয়া জড়ানো পাহাড় ঘেরা শিমলার অনবদ্য পিকচার পোস্টকার্ড। দূরে ১৫০ ফুট হনুমান মূর্তিটি চমৎকার। শিমলা থেকে ৪ কিমি দূরে অসাধারণ অবজারভেটারি হিলস।
আরও পড়ুন: কল্পনার হিমাচল যখন সত্যিকারের
১৮৮৮ সালের লর্ড ডাফরিনের বাংলোটি বর্তমান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ ক্যাম্পাস। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
৫ কিমি দূরের সামার হিলসের চুড়োয় চলে আসুন। তবে এ জন্য হাতে এক দিন সময় বেশি রাখতে হয়। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, চ্যাডউইক ঝর্না, তারা দেবী মন্দির, সঙ্কটমোচন মন্দির আর আনানডেল রেসকোর্স দেখতে দেখতে সারা দিন কোথা দিয়ে কেটে যাবে তা টের পাবেন না।
আরও পড়ুন: উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে জড়ানো মায়া চুম্বক
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা। কালকা থেকে টয়ট্রেনে চলে আসতে পারেন শিমলা। তবে চণ্ডীগড় থেকে শিমলার দূরত্ব ৯০ কিমি। যাঁরা বিমানে আসবেন তাঁরা দিল্লি এসে ট্রেনে অথবা গাড়িতে চলে আসতে পারেন শিমলা।
কোথায় থাকবেন
শিমলায় থাকার জন্য রয়েছে হিমাচল পর্যটন দফতরের হোটেল দি হলিডে হোম (০১৭৭-২৮১২৮৯০/৯৫) email: hhh@hptdc.in ভাড়া ১,৮০০-৬,০০০ টাকা। দি পিটারহফ (০১৭৭-২৮১২২৩৬/ ২৬৫২৫৩৮) email: peterhof@hptdc.in ভাড়া ২,৫০০-৬,০০০ টাকা।
বেসরকারি হোটেলের মধ্য রয়েছে, হোটেল আর্কল্যান্ড (০৮৬২৮৮৬১০১৯) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০। হোটেল পাইনভিউ (০৮৫৮৪৮৫২৭০৫) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০ টাকা। হোটেল গুলমার্গ রিজেন্সি (০১৭৭-২৬৫৩১৬৮) ভাড়া ১,৬০০-২,৫২০ টাকা, হোটেল সান এন স্নো (০৮৬৯৭৭৪৭৬৩১) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০ টাকা। হোটেল শিমলা ভিউ (০৮৬৯৭৭৪৭৬৩২) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০ টাকা। হোটেল ডিপ্লোম্যাট (২৬৫২০০১) ভাড়া ১,৫০০-২,৬০০ টাকা। হোটেল শিবালিক (২৮১১১২২) ভাড়া ৮৫০-১,৮৫০ টাকা। হোটেল পঙ্কজ (০৯১২৯১২২৪২৬) ভাড়া ১,৭০০-৩,০০০ টাকা।
শিমলা কালীবাড়িতে থাকার জন্য আবেদন করতে হবে, শিমলা কালীবাড়ি, সেক্রেটারি, শিমলা-১৭১০০১। ই-মেল করতে পারেন simlakalibari1823@gmail.com. ফোন ০১৭৭-২৬৫২৯৬৪। তবে সিজন অনুযায়ী প্রতিটি হোটেলের ভাড়া বাড়ে কমে।
শিমলার আশেপাশে> অনেকে শিমলাকে ঝাঁকিদর্শনে দেখে যান। কিন্তু শিমলার থেকে আশপাশে ছড়িয়ে আছে অল্পচেনা, অনবদ্য ঠিকানা।
লিটল মাউন্টেন অব হেভেন।
চেইল
‘লিটল মাউন্টেন অব হেভেন’। বিদেশিরা আদর করে এই নামেই ডেকে থাকেন। উদার, উদাস প্রকৃতির বুকে আরও এক অসাধারণ শৈলশহর। পাইন, দেওদারের ছায়ামাখা পথকে সঙ্গী করে। মাত্র ৪৯ কিমি দূরত্বে হিমাচলেরএক মৌনী গ্রাম চেইল।
দেখে নিন
অপরূপ নিসর্গে মোড়া তিন পাহাড়ের কোলে বসানো পাহাড়ি গ্রাম চেইল-এর সৃষ্টির পিছনে এক প্রেমকাহিনি লুকিয়ে আছে। ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইংরেজ কমান্ডার ইন চিফ কিচেন-এর সুন্দরী কন্যার প্রেমে পড়েন পাতিয়ালার মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহ। সেই খবর জানাজানি হতেই মহারাজার শিমলায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহ তখন শিমলার অদূরে চেইলে অপরূপ এক কাঠের প্রাসাদ বানিয়ে ফেলেন।
উপচে পড়া সৌন্দর্যের মাঝে হিমেল বাতাসের অবাধ আনাগোনা। চিরসবুজ বৃক্ষরাজদের আকাশছোঁয়ার চেষ্টা, নীল আকাশের ব্যাক ড্রপে ছবি আঁকা হিমালয়ের পরিপাটি সংসারের ফ্যামিলি অ্যালবাম, জাস্ট অসাধারণ! মখমলি সবুজের ঘাসজমিনে নরম রোদ্দুরের কারুকাজ। সামার প্যালেস আজকের চেইল প্যালেস হেরিটেজ হোটেল। দূরে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে শতদ্রু নদী। চেইলের পাহাড়ের চুড়োয় রয়েছে ক্রিকেট খেলার মাঠ। এক পাহাড়ের মাথায় সামার প্যালেস। আর এক পাহাড়ের মাথায় ক্রিকেট খেলার মাঠ। অন্য পাহাড়ে ‘সিধ বাবা কা মন্দির’, শিখ গুরুদ্বার।
দেখে নিতে পারেন ‘চেইল অভয়ারণ্য’। এক সময় পাতিয়ালা মহারাজাদের মৃগয়াক্ষেত্র। ১১০ কিমির এই অভয়ারণ্য অনুমতি নিয়ে, গাইড সঙ্গে নিয়ে ঘুরে নিতে পারেন। রংবেরঙের পাখি, ভালুক, হরিণ, লেপার্ড-সহ আরও নানান বন্যপ্রাণের দেখা মিলতে পারে।
কী ভাবে যাবেন
শিমলা থেকে সড়কপথে চেইলের দূরত্ব ৪৯ কিমি। চণ্ডীগড় থেকে ১২৩ কিমি। দিল্লি থেকে ৩৩৭ কিমি।
কোথায় থাকবেন: চেইলে থাকার জন্য রয়েছে হিমাচল পর্যটন দফতরের হোটেল দ্য প্যালেস (০১৭৯২-২৪৮১৪১/২৪৮১৪২/২৪৮১৪৩) ভাড়া ২,০০০-১৮,৫০০ টাকা। email>palace@hptdc.in।
বেসরকারি হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল চেইল ইন (০১৭-৯২২৪-৮৫৫৮) ভাড়া ১,৫০০-২,০০০ টাকা। হোটেল মোনাল (০১৭-৯২২৪-৮৫৫৯) ভাড়া ২,০০০-২,৫০০ টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে নানান অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প।
মাসোব্রা।
মাসোব্রা
নানান ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো পাহাড়ের আনাচকানাচে। পাইন আর আপেল খেতের বাহার। হিমাচলের উৎকৃষ্ট আপেলের বাগান এখানেই। হিমেল আবহে পাখিদের মিষ্টি গান শুনতে শুনতে বিশেষ অনুমতি নিয়েই আপেলের বাগান দেখে নিতে পারেন। শিমলা থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে অনাঘ্রাত এই সৌন্দর্যের নাম, মাসোব্রা। নলধেরা থেকে চিন্ডি আসার পথে মাসোব্রা। অধিকাংশ বাংলোই আজ হেরিটেজ হোটেল ও সেনাবাহিনীর অধীনস্থ। নীল আকাশের নীচে মাসোব্রার বাজার থেকে ফল ও ফলের রস অবশ্যই চেখে দেখুন।
ভিমাকালী মন্দির।
হাতুমাতার মন্দির
শিমলা থেকে আঁকাবাঁকা পথের মাঝে নারকান্ডা। এক পাহাড়ি জনপদ। ছোট বাজার, ব্যাঙ্ক আর জনপদ। শীতে পুরু বরফের চাদরে মুড়ে থাকে। নারকান্ডা থেকে পথ দুটো বাঁক নিয়েছে। সোজা এলেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। পাখিদের গান শুনতে শুনতে চলে আসুন। মেরেকেটে ১২ কিমির সংকীর্ণ পথের শেষে মনোরম পরিবেশে হাতুমাতার মন্দির। শিমলা থেকে প্রায় ৭২ কিমি। নতুন ভাবে মন্দিরকে সাজানো হয়েছে। মন্দিরে কাঠের কারুকাজ অসাধারণ। হাতুমাতা আসলে দেবী দুর্গার প্রতিরূপ। তবে শীতে এই রাস্তা সম্পূর্ণ বরফে মুড়ে থাকে।
রামপুর
অনেকেই এড়িয়ে যান। শতলুজ বা শতদ্রু নদীর পাড়ের এক আদ্যোপান্ত শহর। প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র। একসময় এখানেই বুশাহার রাজারা তাদের রাজপাট চালিয়েছেন। তাদের তৃতীয় রাজধানী শহর। রয়ে গিয়েছে তাদের অনবদ্য প্রাসাদটি। পদম প্যালেস। অসাধারণ কাঠের কাজ করা এই প্রাসাদ না দেখলে অনেক কিছুই অদেখা থেকে যায়। প্রতি নভেম্বরে রামপুরের লাভি উৎসব বিখ্যাত। এখানকার লাভি মেলাও বেশ বিখ্যাত।
সারাহান
শিমলা থেকে নারকান্ডা হয়ে রাস্তা ভাগ হয়ে গিয়েছে। সোজা রাস্তাটা চলে গিয়েছে হাতু পিকের দিকে। জমজমাট রামপুরের বুশাহার রাজাদের প্যালেস দেখে আরও ৪০ কিমি।
দেখে নিন
অতীতের শোণিতপুরাই আজকের সারাহান। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট গ্রাম আর বাক্সবাড়ি। প্রতিটি বাড়ির বাগানে আপেল, অ্যাপ্রিকটের বাহার চোখে পড়বে। শীতে সারাহান মুড়ে থাকে বরফের চাদরে। আর অন্য সময় নীল আকাশের নীচে আপেলের ভারে ঝুকে পড়া মায়াবী পথ। দূরের শ্রীখণ্ড পাহাড়ের ঘেরাটোপে তুষারধবল শৃঙ্গরাজদের হাসিমুখ। তারই ব্যাকড্রপে পবিত্র ভিমাকালী মন্দির। হিমাচলের নিজস্ব কাঠকোণা শিল্পে মিশেছে বৌদ্ধশৈলীর অনবদ্য ছোঁয়া। কাঠের উপর সূক্ষ্ম কারুকাজ নিঃসন্দেহে নজর কাড়বে। মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করাই রেওয়াজ।
সতীর ডান কান পড়েছিল সারাহানে। মন্দির চত্বরে রয়েছে আরও বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তি। মন্দির চত্বরে সুন্দর কেয়ারি করা বাগান। মন্দিরের ঠিক পিছনেই বুশাহার রাজাদের কাঠের তৈরি শান্তিকুঞ্জ রাজপ্রাসাদ মনে করিয়ে দেয়, অতীতের শোণিতপুরের ইতিহাস। শীতে বরফে মুড়ে থাকে সারাহান। তবে আপেল দেখতে অগস্ট-সেপ্টেম্বরে আসতে হয়। ক্যামেরা, চামড়াজাত কোনও প্রকার জিনিস নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। রুদ্ররূপী দেবী ভিমাকালীর মূর্তি। দেখে নিন ভিমাকালী মন্দিরের সন্ধ্যারতি। এখান থেকে এক কিমি দূরে পায়ে হেঁটে চলে আসুন পাহাড়ের মাথায়। ট্রাগোপ্যান বা মোনাল পাখিদের প্রজনন কেন্দ্রটি দেখে নিতে ভুলবেন না।
কী ভাবে যাবেন
শিমলা থেকে রামপুর, জিয়োরি হয়ে সারাহানের দূরত্ব ১৮০ কিমি। গাড়িতে চলে আসতে পারেন। সিজন অনুযায়ী ভাড়া বাড়ে-কমে।
কোথায় থাকবেন
সারাহানে থাকার জন্য রয়েছে হিমাচল পর্যটন দফতরের হোটেল দ্য শ্রীখণ্ড (০১৭২৮২-২৭৪২৩৪) ভাড়া ১,৬০০-৯,০০০ টাকা। sarahan@hptdc.in
বেসরকারি হোটেলের মধ্যে রয়েছে ট্রাগোপ্যান (০৯৮৭৪৩৭৩৩৮০) ভাড়া ১,২০০-১,৮০০টাকা। বুশাহার গেস্টহাঊস (২৭৪২৪৮) ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকা। হোটেল স্নো ভিউ (০৮৬৯৭৭৪৭৬৩১) ভাড়া ১,২০০-১,৮০০ টাকা। সিজন অনুযায়ী, প্রতিটি হোটেলের ভাড়া বাড়ে কমে।
ছবি: লেখক