নৈসর্গিক: অজন্তার গুহা। ছবি: তথাগত সিকদার
বিক্রমজি ঠিক চিনতে পেরেছেন আমার হাতের বইটা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সানিয়ালজি কা কিতাব হ্যায় না ইয়ে? বহত দিন বাদ দেখা।’’ ব্যস। পর্যটক ও গাইডে ভাব জমিয়ে দিল বহু বছর আগে লেখা একটি বই। নারায়ণ সান্যাল, বিক্রমের ভাষায় ‘সানিয়ালজি’র লেখা— ‘অপরূপা অজন্তা’। ওই একটি বই হাতে থাকাতেই মিলে গেল বিক্রমজির বন্ধুতা আর অজন্তার অন্তরের পাসপোর্ট। আম বাঙালিকে অজন্তার রহস্য চিনিয়েছে এই বই, বলাটা কি খুব ভুল?
আমরা দু’বন্ধু দেখতে এসেছি অজন্তা-ইলোরা। হ্যাঁ, ‘ঘুরতে’ নয়, ‘দেখতে’। বিশ্বের বিস্ময়কে দেখতে আসতে হয়। এখানে ‘ঘোরাঘুরি’ বেমানান। অওরঙ্গাবাদের সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুক্ষণ পরে পরে ছাড়ে ইলোরা আর অজিণ্ঠা ‘লেনি’ (মানে গুহা) যাওয়ার বাস। মহারাষ্ট্র রাজ্য পরিবহণ সংস্থার লোকাল বাসের সামনে গন্তব্যস্থান লেখা মরাঠিতেই। তাতে কী! কন্ডাক্টর দাদা আর স্থানীয় সহযাত্রীরাই বুঝিয়ে দিলেন, কোথায় নামতে হবে, কত সময় লাগবে, ফেরার সময়ে ঠিক কোথায় এসে দাঁড়ালে বাস পাওয়া যাবে—সব।
সঙ্গে অবশ্য আর একটি বই ছিল। সিস্টার নিবেদিতার লেখা ‘ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’। ১১০ বছর আগের এক শীতার্ত ডিসেম্বরে মন দিয়ে অজন্তাকে দেখে, ফিরে এসে ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন নিবেদিতা, ‘দি এনশিয়েন্ট অ্যাবি অফ অজন্তা’ নামে। সেটাই পরে বই হয়ে বেরোয়। ‘পাহাড়ের মাঝে আধখানা চাঁদের মতো পড়ে আছে’ অজন্তার গুহাগুলো, লিখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন ঝরনার গানের সঙ্গে গুহাবাসী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও শিক্ষার্থীদের প্রাচীন প্রার্থনাগান মিলেমিশে তৈরি নিরবচ্ছিন্ন ঐকতানের কথা। এখানে এসেছিলেন নন্দলাল বসু, অসিত হালদার-সহ কত শিল্পী, দিনের পর দিন অক্লান্ত শ্রমে কপি করে রেখেছেন অবিস্মরণীয় সব গুহাচিত্র। নারায়ণ সান্যালের লেখা বইয়ে এক-একটি গুহা ধরে ধরে লেখা— কার গায়ে কোন জাতকের কাহিনি আঁকা, কোন দেওয়ালের সামনে দাঁড়ালে দেখা যাবে অবলোকিতেশ্বর বা অপরূপ পদ্মপাণি, কপিলাবস্তুতে বুদ্ধের সামনে পুত্র রাহুলকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন গোপা। অথচ সত্য এই— বইয়ে যা পড়েছি, সামনে কই দেখতে পাচ্ছি না তো! মুছে গিয়েছে কত কিছু। প্রকৃতির নিয়মে আর মানুষের মূঢ়তায়। অনেক দেওয়াল আর ছাদ ঢাকা— সংস্কারকাজ চলছে। মনখারাপ হল। আবার ভালও লাগল। এখনও যেটুকু আছে, যদি ঠিকঠাক রাখা যায়!
শৈল্পিক: ইলোরার বিখ্যাত কৈলাস মন্দির
মুক্তকণ্ঠে স্বীকারে বাধা নেই, এক ইলোরার ১৬ নম্বর ‘কৈলাস’ গুহা দেখতেই আমাদের দু’বন্ধুর কেটে গিয়েছে একটা গোটা দিন। ‘কীর্তি’ বুঝি একেই বলে! এর সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া পথ থাকে না কোনও। বিরাট একটা পাথর (আদতে পাহাড়), কত জনের হাতের গুণে একটা মন্দির হয়ে উঠেছে! কারা এই নাম-না-জানা শিল্পী? কে বানিয়েছেন ওই ষোলোখানা স্তম্ভের মণ্ডপ, ধ্বজস্তম্ভ, নন্দীমণ্ডপ, রামায়ণের প্যানেল? যে কল্পনায় শিবের হাতে উঠতে পারে বীণা, হরপার্বতীর বিয়ের উৎসবমুহূর্ত ফুটে ওঠে পাথরের গায়ে, প্রবল ক্রোধে পৃথিবী কাঁপান দশানন, সুখসংবাদ দিতে উড়ে যান কোনও গন্ধর্ব— তার উৎস কোন শিল্পী মন? আবার বৌদ্ধ গুহাগুলো, বা পার্শ্বনাথের মন্দির-সহ খান পাঁচেক জৈন গুহার পরিবেশ আর সজ্জা একেবারে আলাদা। স্থাপত্য কি ভাস্কর্যের প্রথাগত পাঠ পায়নি যে মানুষ, অজন্তা-ইলোরার সৌন্দর্য আত্মস্থ করতে তারও অসুবিধে হবে না কিছুমাত্র। এ এক অন্য ভারতবর্ষ। তত্ত্বের, শিল্পের, প্রার্থনার। ত্যাগের, উপভোগেরও। হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন এখানে আলাদা আইডেন্টিটি কার্ড নিয়ে ঘোরে না। ইতিহাস, ধর্ম আর শিল্প এখানে ঘুমিয়ে আছে পাথরের খাঁজে-ভাঁজে।
শৈল্পিক: ইলোরার অপূর্ব গুহাভাস্কর্য
সন্ধের মুখে, যখন অজন্তা বন্ধ হব-হব, একেবারে শেষ গুহাটার চাতালে দাঁড়িয়ে আছি— বৃষ্টি এল। ঘন সবুজ পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এল এক-একটি প্রাণস্পন্দী প্রপাতধারা! কালো মেঘ, কালো পাথরের গুহা গাঢ় ছায়া ফেলেছিল চরাচরে। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, অজন্তার বর্ষায় যে ভেজেনি, তার জীবনটাই বৃথা। দ্বিতীয় দিন ইলোরার বাকি বৌদ্ধ ও জৈন গুহাগুলো দেখে ফিরছি, বৃষ্টিভেজা আকাশে হেসে উঠল রামধনু। দু’-দু’টো! গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম, বাকি পথ হেঁটে ফিরব। মুখ টিপে হেসেছিল কেউ কেউ, এরা কি পাগল?
সকলেই পাগল নয়। কেউ কেউ বটে। তবে অজন্তা-ইলোরার যে পাগল-করা ক্ষমতা আছে ষোলো আনা, এর চেয়ে সত্য ভূভারতে নেই।