ক্রিকেটের গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা হল না। হতাশ ধোনিকে দেখতে হল পেরেরাদের উল্লাস। রবিবার মিরপুরে। ছবি: এএফপি
ত্রিমুকুটের সরণিতে এসে নাটকীয় ভাবে প্রত্যাখ্যাত মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
ক্রিকেট-অদৃষ্টের সঙ্গে তাঁর যে বিখ্যাত যোগাযোগ সাত বছর আগে জোহানেসবার্গ ফাইনালের রাত্তির থেকে শুরু, রবিবাসরীয় মিরপুর তাকে সম্মান করার কোনও কারণ দেখেনি। বরং বিশ্ব ফাইনাল মঞ্চে যারা চিরকালীন কর্ণ হিসেবে পরিচিত এবং চার-চার বারের বিজিত, তাদেরই সিংহাসনে বসিয়ে দিল। আঠারো বছর পর লঙ্কা আবার সোনার! জয়সূর্যদের লাহৌরে সেই ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জেতার পর এটা এল টি-টোয়েন্টি থেকে। ধোনির ফাইনাল-ভাগ্যের দর্পচূর্ণ করে একপেশে ছয় উইকেটে।
গোটা টুর্নামেন্টে অবিসংবাদী অপরাজেয় থেকে টিম ইন্ডিয়ার ফাইনাল-ব্যর্থতা নিছকই একটা ম্যাচে ল অফ অ্যাভারেজ মেনে ভেঙে পড়া নয়। নিখাদ ক্রিকেটীয় কারণভিত্তিক। এক, মালিঙ্গা আর কুলশেখরার অনবদ্য ডেথ ওভার বোলিং। পরের পর নিখুঁত ওয়াইড ইয়র্কারে দগ্ধ ভারত হাতে এতগুলো উইকেট নিয়েও শেষ চার ওভারে মাত্র ১৯ জুড়তে পেরেছে। দুই, যুবরাজ সিংহ-র চূড়ান্ত স্বার্থপর এবং দলবিরোধী ব্যাটিং। কোনও অঙ্কেই চার নম্বর ব্যাটসম্যানের ২১ বল খেলে একটাও বাউন্ডারি না মারতে পারার ব্যাখ্যা হয় না। ভারতকে বিশ্বকাপ দিয়েছিলেন যুবরাজ। এই কাপ ফাইনালটা হারিয়ে দিয়ে গেলেন। মার্টিন ক্রো খেলার পর ব্যাখ্যা করছিলেন, এমন অদ্ভুত টি-টোয়েন্টি ফর্ম্যাট যে, কোনও একটা ব্যাটসম্যানের ব্যর্থতা গোটা টিমকে ডুবিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু তিন নম্বর কারণটাই মারাত্মক আর ম্যাচের ওপর সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে গেল। ক্রিকেট-যুক্তি আর বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে সব অব্যর্থ পাশার চাল চেলে থাকেন এমএসডি, আজ সেগুলো একটাও কাজ করেনি। বরং ধোনির জীবনে বহু বছর বাদে দাঁড়িপাল্লায় ফাটকাকে হারিয়ে ক্রিকেট-যুক্তির ওজনশালী হয়ে পড়ার দিন ছিল। ছিল ক্রিকেট-সাহিত্যেরও দিন। নিছক ক্রিকেট-কীর্তির নয়। আর এই মুহূর্তে কুমার সঙ্গকারার চেয়ে বড় ক্রিকেটীয় রোমান্স আর কী হতে পারে। বিদায়ী ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পর সঙ্গকারা ছুটে এলেন ফটোগ্রাফারদের দিকে। পরিচিত এক শ্রীলঙ্কান আলোকচিত্রীর দিকে ছুড়ে দিলেন একটা কিছু। দূর থেকে মনে হল গ্লাভসটাই দিয়ে দিলেন।
জাম্পকাটে তখনই মনে পড়ে গেল সাত বছর আগের জো’বার্গ ফাইনাল-পরবর্তী দৃশ্য। সম্পূর্ণ অপরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকান ভলান্টিয়ার এসে জার্সিটা চেয়েছে আর খুলে দিয়ে দিচ্ছেন ধোনি! সে দিন থেকে ভাগ্যের সওয়ার হয়ে তিনি যেমন চাবুক চালিয়েছেন, ঘোড়া তেমনই চলেছে। কাপ ফাইনালে শেষ ওভার হিসেবের ভুলে দিয়েছিলেন যোগিন্দর শর্মাকে। ঠিক যেমন শারজায় কপিল একই ভুলে শেষ ওভার করিয়েছিলেন চেতন শর্মাকে দিয়ে। ধোনির ভুলটাও বিজয়ীর ট্রফি হয়ে যায় মিসবার স্কুপটা শ্রীসন্তের হাতে চলে যাওয়ায়। কপিলের বেলা ওটাই ছিল শোকবিহ্বল মিয়াঁদাদের ছক্কা। এ রকম ফাটকা পরবর্তীকালে ভুরি ভুরি খেলেছেন। কিন্তু ধোনির বিজয়রথ থামেনি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সহবাগ-শিবির বহু বার অনুযোগ করেছে, ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা খুঁজতে যেও না। ও যা ধরবে তা-ই সোনা।
সঙ্গকরা। বিদায় বেলায় নায়ক।
এ দিনের মিরপুর দেখাল, ধোনির এত কাল জিতে যাওয়া পাশার দানগুলো উল্টে গেলে কী মারাত্মক আকার নিতে পারে। পুরো টিম ছাড়াও তা বনবাসে পাঠিয়ে দিতে পারে স্বয়ং বিরাট-রাজকে! ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট-ই শুধু হলেন না বিরাট। আজ এমনও শুনলাম, সেরা বাছার নির্বাচনী সভায় নাকি দ্বিতীয় কোনও নামই ওঠেনি। এমনকী অশ্বিনের নামও না। ফাইনালে আবার অনবদ্য ইনিংস খেললেন কোহলি। ৫৮ বলে ৭৭। বাকি টিম যেখানে করেছে ৬২ বলে ৫৩। খেলার পর টুইটারে দেখছিলাম, ভিভ-কন্যা মাসাবা গুপ্ত পর্যন্ত তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ভিভের উত্তরাধিকার হওয়ার দিকে সত্যিই তিনি এগোচ্ছেন। অথচ বেচারি কোহলি শেষ চার ওভারে মাত্র ৮ বল খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
যখন শেষ পাঁচ ওভার শুরু হবে এবং যুবি চূড়ান্ত ঠুকুস-ঠুকুস শুরু করেছেন, দৌড়ে এলেন তোয়ালে কাঁধে টিমের কেউ। বোঝা গেল ধোনির নির্দেশ আসছে। বিরাটকে কিছু বলা হল। দু’ওভার পরে আবার লোকটির আবির্ভাব। কিন্তু বিরাট কী করবেন? তিনি তো স্ট্রাইকই পাচ্ছিলেন না।
এখানেই ধোনির সিদ্ধান্ত ক্রিকেটীয় যুক্তি ছেড়ে ভ্রমাত্মক পাশার দান হয়ে যায়। এগারো ওভারে রানটা তেমন কিছু ওঠেনি যুবি-কে কেন পাঠানো হবে? তখন ধোনি নিজে নামতে পারতেন। যাঁকে শ্রীলঙ্কা এত ভয় পায়। ইন-ফর্ম রায়নাকে পাঠাতে পারতেন যিনি রোজ রান করছেনই শুধু নয়, সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট নিয়ে রান করছেন। এটা কী ধরণের পাশার চাল যে, টিম করবে মাত্র ১৩০। ধোনি খেলবেন মাত্র ৭ বল। আর রায়না ব্যাটই পাবেন না! আসলে নিজের ক্রিকেটীয় গোঁয়ার্তুমি অব্যাহত রেখে সেই যুবরাজকেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধোনি। অশ্বিনকে দিয়ে আবার বোলিং শুরু করালেন না বিপক্ষ এত কম টোটাল তাড়া করছে দেখেও। অথচ সেমিফাইনালের মতোই অশ্বিন এসেই প্রথম ওভারে উইকেট। তখন ৩৭ তুলে ফেলেছে শ্রীলঙ্কা। আর বোলারের ওভার বাঁচিয়ে লাভ নেই। জেতার একমাত্র রাস্তা, বিপক্ষকে অল আউট করা। অথচ অশ্বিনকে তিনি এক ওভার করিয়েই সরিয়ে দিলেন। ম্যাচ আরও হাতের বাইরে চলে গেল। সেমিফাইনালে ঠিক একই ট্যাকটিক্যাল ভুল তিনি করেছিলেন। কিন্তু সেখানে রান তাড়া সফল ভাবে হওয়ায় ফাটকা খেটে গিয়ে ভুলগুলো চাপা পড়ে গিয়েছিল। যেমন শামিকে না খেলানো। শিখর ধবনকে আবার বসিয়ে দেওয়া। সেমিফাইনাল থেকে এই বদল শুরু করেছিলেন ধোনি। সে দিনও পরিবর্তনে ভাল কাজ দেয়নি। কিন্তু জয়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেনি। আজ সেগুলো বেরিয়ে পড়বেই।
যুবরাজের বিরুদ্ধে টুইটার আর ফেসবুকে জোক বেরিয়ে পড়েছে, আন্দাজ করারই কথা। কিন্তু যেখানে টার্গেট অজানা, যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে, সেখানে ইন-ফর্ম প্লেয়ার অগ্রাধিকার পাবে না? অন্তত আরও তিরিশ থেকে চল্লিশ রান হল না, স্রেফ ভুল স্ট্র্যাটেজিতে।
শ্রীলঙ্কা ডেথ ওভারে দারুণ বল করেছে। ব্যাট করার সময় চোকিংয়ের কোনও লক্ষণ দেখায়নি। কিন্তু তারা যত না ম্যাচটা জিতল, তার চেয়ে বেশি স্ট্র্যাটেজির একগুঁয়েমিতে ভারত হারল। এমএসডি এই হার সত্ত্বেও দেশের সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক থেকে যাবেন। বিশ্বক্রিকেটে টেস্টে এক নম্বর র্যাঙ্কিং। দুটো বিশ্বকাপ। একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। কোনও ভারত অধিনায়ক আগামী পঞ্চাশ বছরেও পারবে কি না, ঘোরতর সন্দেহ। তাই ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে ধোনিবাদ থেকেই যাবে। তার আর প্রসার হোক বা না হোক।
কিন্তু রোববারের হেরো ফাইনালটাও এতকালের প্রতাপশালী ধোনি আর ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছিল। ত্রিমুকুটের মূল্য দিয়ে তিনি বুঝলেন যে, ভাগ্যের সহায়তাও অনন্ত হয় না। একটা সময় ক্রিকেটীয় যুক্তিকে সে-ও রাস্তা ছেড়ে দেয়। নইলে আজও তো অদৃষ্ট সাহায্য করেছিল! কোহলির সহজ ক্যাচ শর্ট মিড উইকেটে ফেলেন মালিঙ্গা। তিনি তখন মাত্র ১১। ভেবেছিলাম খেলার পর কোহলি গিয়ে বলে আসবেন লঙ্কা অধিনায়ককে, ওহে তুমি সেই মুহূর্তে কাপটাই ফেলে দিয়েছিলে! ঠিক যেমন স্টিভ ওয় বলেছিলেন হার্শেল গিবসকে।
কিন্তু চান্স-ফ্যাক্টর নিয়ে এত ছেলেখেলা করলে অদৃষ্টের দোষ কী! সে তখন লজ্জিত ভাবে ক্রিকেট-লজিককে জায়গা ছাড়তে বাধ্য। বদলাবেন ধোনি মিরপুর-পরবর্তী সময়ে? পাশায় হেরে কর্ণকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজেরা বনবাসে চলে যাওয়ার পর? যুবরাজ আর কখনও সুযোগ পাবেন ভারতীয় দলে? সময় বলবে...।
ফাইনালের স্কোর
ভারত
রোহিত ক সেনানায়কে বো হেরাথ ২৯
রাহানে বো ম্যাথেউজ ৩
কোহলি রান আউট ৭৭
যুবরাজ ক পেরেরা বো কুলশেখরা ১১
ধোনি ন. আ. ৪
অতিরিক্ত: ৬, মোট ২০ ওভারে ১৩০-৪।
পতন: ৪, ৬৪, ১১৯, ১৩০।
বোলিং: কুলশেখরা ৪-০-২৯-১, ম্যাথেউজ ৪-০-২৫-১, সেনানায়কে ৪-০-২২-০, মালিঙ্গা ৪-০-২৭-০, হেরাথ ৪-০-২৩-১।
শ্রীলঙ্কা
কুশল ক জাডেজা বো মোহিত ৫
দিলশান ক কোহলি বো অশ্বিন ১৮
জয়বর্ধনে ক অশ্বিন বো রায়না ২৪
সঙ্গকারা ন. আ. ৫২
থিরিমানে ক ধোনি বো মিশ্র ৭
পেরেরা ন. আ. ২১
অতিরিক্ত ৫, মোট ১৭.৫ ওভারে ১৩৪-৪।
পতন: ৫, ৪১, ৬৫, ৭৮।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৩-০-১৮-০, মোহিত ২-০-১৮-১, অশ্বিন ৩.৫-০-২৭-১, মিশ্র ৪-০-৩২-১, রায়না ৪-০-২৪-১, জাডেজা ১-০-১১-০।