অধিনায়ক ও তাঁর বিরাট ভরসা। অনুশীলনের ফাঁকে, হাল্কা মেজাজে। শনিবার ঢাকায়। ছবি: এপি
একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্ট জিতলেই লোকে বিচিত্র কত সব কাণ্ডকারখানা করে। কেউ ইয়ারা নদীতে ঝাঁপ দেয়। কেউ হাঁটু গেড়ে কোর্টে শুয়ে পড়ে। কেউ লাফিয়ে গ্যালারিতে চলে যায়। তিনি— মহেন্দ্র সিংহ ধোনি রোববার আইসিসি টুর্নামেন্টে ত্রিমুকুট সম্পন্ন করে ফেললে কী করতে পারেন? সব সময়ই তাঁর মধ্যে একটা অভিনবত্ব কাজ করে। সে সচিনকে শেষ টেস্টে গার্ড অব অনার দেওয়ার ভঙ্গিই হোক বা গত কাল ওই উইনিং স্ট্রোক না মেরে ইচ্ছাকৃত ডট বল খেলা! সবেতেই তাঁর নিজস্ব বিবৃতি থাকে— অননুকরণীয় এমএসডি ছাপ।
ওয়ান ডে-তে বিশ্বকাপ তাঁর দখলে! মধ্যবর্তী সব চেয়ে বড় ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি— সেটাও তাঁর গত বছর জেতা। বাকি আছে শুধু কুড়ি ওভারের ট্রফি! সেটা সাত বছর আগে জিতলেও এখন তো হাতছাড়া। কাজেই ২০০৭ আর ট্রিপল ক্রাউনের হিসেবের মধ্যে পড়বে না। এখনকার জন্য রোববারেরটা জিততে হবে। অবিশ্বাস্য সেই কীর্তি থেকে ধোনি মাত্র এক ম্যাচ আর চব্বিশ ঘণ্টা দূরে। একই সময়ে পরপর তিনটে ট্রফির মালিক হয়ে আইসিসি ত্রিমুকুট আজ অবধি ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ জেতেনি। বোধ হয় ভাবেওনি। যে অধিনায়ক এটা প্রথম জিতবে, ইতিহাস তাকে প্রথম পাঁচশো উইকেট নেওয়া বা দশ হাজার রান করা মানুষের মতোই অমর করে রাখবে। এমএসডি সেই অমর হওয়ার সরণির শেষ ট্র্যাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে!
মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে অবিসংবাদী ফেভারিট টিমের অধিনায়ক হিসেবে তিনি ট্রফি তুললেও অবশ্য বাংলাদেশ তাঁকে নিয়ে আলাদা করে আলোড়িত হবে বলে মনে হয় না। ধোনি এ দেশে নিছকই এক জন চূড়ান্ত সফল অধিনায়ক। ঘটনাচক্রে যিনি ভারতের নেতৃত্ব দেন। অথচ বাংলাদেশি জনগণের কাছে সরাসরি তাঁর আবেগের কোনও তরঙ্গ পৌঁছয় না। বাংলাদেশি আমজনতা যাঁদের জাতিগত পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে মাল্যবান করে রাখে, এমন ‘ক্রসওভার’ ক্রিকেট নায়কের সংখ্যা মাত্র দুই। সচিন ও সৌরভ। সীমান্তের কোনও কাঁটাতার বা ফরাক্কার পানি নিয়ে সংঘাত সেখানে কাজ করে না। অথচ ধোনির অত্যাশ্চর্য কৃতিত্ব সেখানে আটকে যায়। তাই তিনি সেই দৌড়ে ধোনিই থেকে যান। সচিন বা সৌরভ হতে পারেন না।
ঘটনা হল, এটা নিছকই বাংলাদেশি জনগণের মনোভাব। বিশ্বক্রিকেটের সঙ্গে তার কোনও সখ্য নেই। তারা এমএসডি-র চূড়ান্ত গুণমুগ্ধ। আজ দুপুরে যে টুর্নামেন্টের সেরা এগারো বাছা হল এবং কাল নাম জানানো হবে, তাতে বাংলাদেশ ভূমি থেকেই ধোনি ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হলে একটুও আশ্চর্য হওয়ার নেই।
বাইরের পৃথিবী কাল রাত্তিরের পর আরও সবিস্ময়ে বলছে, তুমি কেমন করে ক্যাপ্টেন্সি করো হে ধোনি? আধুনিক ক্রিকেটে নিছক পারফরম্যান্স বিচারে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো দ্বিতীয় কোনও নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। আরও একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, তাঁর ট্রফি জেতাগুলো ঘটছে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে যেখানে ক্যাপ্টেন নিজে আহামরি কিছু ঘটাচ্ছে না। অথচ তাঁর টিম পরের পর আইসিসি টুর্নামেন্ট জিতেই চলেছে। বিশ্বকাপে ধোনির ওয়াংখেড়ে ইনিংস এবং শেষ বলের ছক্কা প্রবাদে পরিণত। অথচ ফাইনালের আগে তিনি একটা ম্যাচেও রান পাননি। লন্ডনে গত বার চাপের মুখে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলেন বলে এত ধন্য ধন্য হল। সেখানে এক বারও তিনি তিরিশ পেরোননি। ফাইনালে করেন শূন্য। এ ছাড়া আর এক বারই ব্যাট করেন। সেখানে রান ছিল মাত্র ২৭। মিরপুরে আবার অদ্যাবধি ২৫ পেরোনোর সুযোগ হয়নি। সর্বোচ্চ রান— ২৪। ওয়ার্ল্ড কাপ তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছিল যুবরাজ সিংহের ফর্ম। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জেতান শিখর ধবন। আর এখানে খেলছেন কোহলি-অশ্বিন। নায়ক তো দূরে থাক, ধোনি পার্শ্বচরিত্রও নন। কিন্তু প্রত্যেকটাতেই একটা ব্যাপার কমন— তাঁর অধিনায়কত্ব এবং শেষে বিজয়মঞ্চে ওঠা।
মাইক ব্রিয়ারলি, যাঁর সঙ্গে এখন টানা হচ্ছে ধোনির তুলনা।
আজ থেকে ছয় বছর আগে অপ্রত্যাশিত ভাবে ধোনিকে যিনি ক্যাপ্টেন বেছেছিলেন, তাঁকে ধরা গেল সন্ধেবেলা মুম্বইয়ে। ফোনে। একটু তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন। কিছু পরেই যে চায়না গার্ডেনে তাঁর সাতান্নতম জন্মদিনের পার্টি শুরু। আমন্ত্রিত অনেক ক্রিকেটার। তারই মধ্যে ধোনি-প্রসঙ্গ উঠলে অবশ্য মুগ্ধ বিস্ময়ে একটুও তাড়াহুড়ো করলেন না দিলীপ বেঙ্গসরকর। “ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্যাপ্টেন তো নিশ্চয়ই। কিন্তু ‘দ্য বেস্ট’ কী করে বলি। অবিশ্বাস্য এই ছেলেটার অদৃষ্ট। কারও না কারও জন্য ঠিক বেরিয়ে যায়। আমি এই রকম দেখিনি। এটা দিয়েই ওকে ওপরওয়ালা পাঠিয়েছেন,” বলছিলেন বেঙ্গসরকর।
ধোনি কি তা হলে আধুনিক ক্রিকেটের মাইক ব্রিয়ারলি হয়ে দেখা দিলেন? টিমে যাঁর সব চেয়ে প্রভাবশালী অংশগ্রহণ ব্যাট নয়। মগজাস্ত্র দিয়ে। নাকি ব্রিয়ারলি ছিলেন ধোনির আবির্ভাবের আগে ক্রিকেটের এক ছোট ধোনি? তর্কটা এ বার ওঠার সময় হয়েছে।
ব্রিটিশ মিডিয়ার যাবতীয় ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও কঠোর বাস্তবটা প্রকাশিতই থেকে গিয়েছে যে, অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ব্রিয়ারলি কখনও পূর্ণ শক্তির অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে অ্যাসেজ জেতেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেননি। ধোনির মতো কয়েকশো কোটি ক্রিকেট উচ্চাকাঙ্ক্ষী জনতা আর মিডিয়ার অন্তহীন চাপ নিতে হয়নি তাঁকে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কোনও চ্যানেল তাঁকে নিয়ে খবর চালায়নি যে, সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া বন্ধ খামে ওঁর নাম রয়েছে। দেশজ মিডিয়ার সঙ্গে এত তিক্ত সম্পর্ক ছিল না ব্রিয়ারলির। নিরন্তর তাদের বিরুদ্ধেও তাঁকে মাঠের বাইরে দ্বিতীয় ম্যাচটা নেতৃত্ব দিতে হয়নি। কাগজে পড়তে হয়নি জল্পনার ওপর ভাসিয়ে দেওয়া খবর— স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা!
ব্রিয়ারলি আর ধোনিতে একটাই মিল। দু’জনেই নিজেদের মতো করে টিম পারফরম্যান্সের একটা আদর্শ ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পেরেছেন। যার ওপর দাঁড়িয়ে টিম সপাটে চালাতে পেরেছে। যে চালানোয় কখনও উঠে এসেছেন ইয়ান বোথাম। কখনও বিরাট কোহলি। এই জায়গাটাই তাঁদের সব চেয়ে বড় ইনপুট। যা স্কোরবোর্ডে দেখা যায়নি। কিন্তু পারফরম্যান্সের এক্স রে-তে সবার আগে ধরা পড়ে।
বাংলাদেশে এ বার চূড়ান্ত চাপের মুখে ধোনির নেতৃত্ব দেওয়া দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে, ব্রিয়ারলির মতো তিনি টিম মিটিংয়ে জোর দেন না। কচিৎ বৈঠক করেন। কিন্তু আসল থেরাপি করেন মিটিংরুমের বাইরে। ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মার্কা অদ্ভুত শীতল টেম্পারামেন্ট দিয়ে সবাইকে একটা শান্ত জোনে রেখে দিতে পারেন। অধিনায়কের দিকে তাকিয়ে সবাই ভাবতে থাকে, এর যখন কোনও কিছুতেই রেখাপাত হচ্ছে না তখন আমারই বা কেন হবে?
গত এক বছরেরও বেশি ধরে ভারতীয় মিডিয়ার সঙ্গে ভয়ঙ্কর হানাহানি চলছে ধোনির। ফাইনাল প্রাক্কালে এ দিন মিরপুরে তারাও যেন শান্তির পতাকা তুলে জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, তুমি সত্যিই বীর। চলো আজ যুদ্ধ নয়। এ বার বিরতি ঘোষণা করা যাক। ধোনি বোধহয় খানিকটা বিস্মিতই হয়েছেন এ দিনকার নতজানু মিডিয়া-মনোভাব দেখে। তাদের কিছু নমুনা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছি।
• এত চাপ আর বিরুদ্ধ মনোভাব সামলান কী করে?
• আইসিসি টুর্নামেন্ট এলেই যে আপনার নেতৃত্বে আশ্চর্য রূপান্তর হয়, সেটা নিজে কি বোঝেন?
• মাঠের বাইরের আবেগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার জন্য কী কী করতে হয়?
• মাঠের মধ্যে চাপ এবং খেলার পরিস্থিতি নির্বিশেষে এই যে আপনার মুখে অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে, এটা কি নিয়েই জন্মেছেন?
ধোনি একটা ইন্টারেস্টিং কথা বললেন যা ওঁর মুখে আগে শুনিনি। “একটা টিম আবহাওয়া ভেতরে তৈরি করতে হয় যেখানে সবাই যার যার কাজের প্রতি দায়িত্ববান হবে। যে দিন বল ঘুরছে, সে দিন স্পিনাররা দলকে টানবে। যে দিন পেস সহায়ক হবে, সে দিন পেসাররা লোড নেবে। কোনও দিন আবার ব্যাটসম্যানদের জেতাতে হবে। সব কিছুই ঘুরবে টিমকে ঘিরে।” ঢাকায় আরও বেশি করে এক এক সময় মনে হচ্ছে, এই যে বহির্জগতের চূড়ান্ত চাপের মধ্যেও টিমটা একেবারে নির্জন দ্বীপের মতো আলাদা অথচ হাসিখুশি, এটাই অধিনায়ক ধোনির মগজাস্ত্র। সুখী সংসার সৃষ্টি। একটা ইলিউশন তৈরি করতে পারা যেখানে কোনও মিডিয়া নেই। বোর্ড কর্তা নেই। প্রাক্তন ক্রিকেটার নেই। মন্ত্র হল: মন দিয়ে খেলো। সব বিপদ দূর হয়ে যাবে।
ধোনির কোর গ্রুপটার মডেল হল, তারা কখনও পেছনের ইতিহাস নিয়ে ভাববে না। সামনেও বেশি ঝুঁকবে না। তারা শুধু এই মুহূর্তে যে কাজটা তুলতে হবে, তাতেই থাকবে। এখন যেমন ধোনি বলছেন, “ত্রিমুকুট আগে কেউ জেতেনি। জিতলে কী অসাধারণ কীর্তি হবে, ও সব ভাবতেই চাই না। আগে ফাইনালটা জিতি, সেটা জেতায় মন দিই। তার পর তো এ সব আলোচনা এমনিতেই আসবে।” ডেল কার্নেগির সেই বিখ্যাত থিওরি: সেতুটা আসার আগে সেতুটা পার হওয়া নিয়ে বেশি ভাবতে গেলে অনর্থক টেনশন ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না।
ধোনি আরও একটি বিশেষ দর্শনে বিশ্বাসী। তা হল আবেগহীন, প্র্যাকটিক্যাল ক্রিকেট-মনন। “আবেগটাকে ছেঁটে নামতে হবে। আবেগ থাকলে কিছুতেই মাঠে প্র্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত নিতে দেবে না। আমি আবেগটাকে কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারণ, আমি ছোটবেলা থেকেই হারতে পছন্দ করি না,” এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন ধোনি। গলায় একটা তৃপ্তি, যা সচরাচর তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখা যায় না।
দর্শনটার বিরোধিতা করবেন অনেকে। সৌরভ-মডেল তা নয়। কোহলি-মডেল তা নয়। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে? নাহ্। সাফল্যের বিরুদ্ধে কে কবে যুদ্ধ জিতেছে? কাল ফাইনাল হারলেও ধোনিই যে সফলতম ভারত অধিনায়ক থাকছেন!