কোচের ভূমিকায় যুবরাজ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
ক্রিকেটার যুবরাজ সিংয়ের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর তা ছুড়ে দিচ্ছেন খোদ তিনিই!
টিম ইন্ডিয়ার সদস্য হিসেবে অজস্র সাফল্য, কীর্তি রয়েছে পঞ্জাব-তনয়ের। কিন্তু, কোচ হিসেবে সে সব কীর্তি ছাপিয়ে নতুন শিখর স্পর্শ করতে পারেন তিনি। অন্তত বাবা, যোগরাজ সিংয়ের চোখে সে ভাবেই ধরা পড়ছে কোচ যুবির ভবিষ্যৎ। ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিভার যে বিচ্ছূরণ নজর কেড়েছিল বিশ্বক্রিকেটে, কোচ হিসেবেও তা হতে চলেছে বলে মনে করছেন গর্বিত পিতা। তাঁর মতে, কোচ হিসেবে নয়া ইনিংসেও ছেলেকে আগের মতোই ঝকঝকে আর দাপুটে দেখাবে।
আশা নয়, এটা নিখাদ বিশ্বাস। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “কোচ হিসেবে আমি যেখানে শেষ করেছিলাম, ও তারই এক্সটেনশন। খুব ভাল কোচ। কোচিংয়ের লেভেল পাশ করে কোচ হওয়া যায় না। বই পড়েও কোচিং হয় না। ক্রিকেটটা বুঝতে হয়। আগে তো খেলাটাকে জানতে হবে, তার পরে কাউকে খেলানো যাবে ঠিকঠাক। যুবি খুব ইন্টেলিজেন্ট। দুর্দান্ত পড়তে পারে ক্রিকেটারদের। বুঝতে পারে কার কোথায় সমস্যা, কার কোনটা দুর্বলতা। ওর কথা শুনে উন্নতি করছে ক্রিকেটাররা। আমার তো মনে হচ্ছে ও ওয়ান্ডারফুল এক জন কোচ।”
পিতা-পুত্র। যোগরাজের সঙ্গে যুবরাজ। —ফাইল চিত্র।
চন্ডীগড়ে পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রিকেট শেখাচ্ছেন যুবরাজ সিং। সেখানেই রয়েছেন শুভমন গিলরা। কেমন কোচিং করাচ্ছেন পুত্র? বাবা শোনালেন, “শুভমন গিলের বটম হ্যান্ডের সমস্যা কিন্তু এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে যুবির কথায়। আর একটা ছেলে আছে। বাঁ-হাতি। নাম অভিষেক। ও হল আর একটা যুবরাজ। নজর কাড়ার মতো আরও দুই-তিনটে ছেলে রয়েছে। অনেক উন্নতি করেছে এরা।”
কিন্তু করোনা অতিমারির আবহে কী ভাবে চলছে ট্রেনিং? যোগরাজের কাছে জানা গেল, গাইডলাইন সব মেনেই চলছে শিবির। মাস্ক, স্যানিটাইজার থাকছে। মানা হচ্ছে সামাজিক দূরত্বের বিধিও। যোগরাজ আশ্বস্ত করলেন, “এখন তো আর সারা দেশে লকডাউন নেই। তাই চলছে ট্রেনিং। তবে করোনার সংক্রমণ আটকাতে সতর্কতা থাকছে পুরো দস্তুর।” তিনি নিজেও শুরু করেছেন শুটিং। পঞ্জাবি সিনেমায় তিনি ব্যস্ত অভিনেতা। ক্রিকেটার জীবনে দাঁড়ি পড়ার পর এসেছেন রুপোলি পর্দার জগতে। ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ সিনেমায় মিলখার কোচ বললেন, “সবে শুরু হয়েছে শুটিং। তবে ৫০ জনের বেশি থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। সব নিয়ম মেনেই চলছে শুটিং। আমি অবশ্য মাঝে মাঝে যুবির সঙ্গে চলে যাই ট্রেনিংয়ে। দেখি ও কী ভাবে শেখায়। ভাল লাগে।”
আরও পড়ুন: তর সইছে না বুমরার, অপেক্ষা মাহি শটের
কী ভাবে কোচিংয়ে এলেন যুবি? যোগরাজ সিংহ বললেন, “পঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (পিসিএ)-র সচিব পুনিত বালি দায়িত্ব দিয়েছে যুবিকে। দু’জনে মিলে দারুণ কাজ করছে। পুনিত নিজেও খুব পরিশ্রম করছে। আর যুবি তো পড়েই রয়েছে বাচ্চাদের নিয়ে। দেখুন, ভাল লোক খুব কম পাওয়া যায়। আর পাওয়া গেলে তাঁদের যত্ন নিয়ে রাখতে হয়।”
যত্ন নেওয়া! পাশে থাকা! ঠিক এগুলিরই যে অভাব বোধ করেছিলেন ক্রিকেটার যুবরাজ। সম্প্রতি তিনি তা বলেওছেন। জানিয়েছেন, সুরেশ রায়না, রবীন্দ্র জাডেজাদের যে ভাবে আগলে রেখেছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, তেমনটা করেননি তাঁর সঙ্গে। যোগরাজ নিজেও অতীতে বার বার মুখ খুলেছেন ছেলের প্রতি ধোনির ‘অন্যায় আচরণ’ নিয়ে। অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে ছেলেকে, বার বার অভিযোগ তুলেছেন। এখন যুবরাজ নিজেই সেই সুরে গলা মিলিয়েছেন। বাবাকে অবশ্য খানিকটা উদাসিনই শোনাল। বললেন, “যুবি অবসর নিয়ে ফেলেছে। এখন আর বলে কী হবে? বিষয়টা ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন ও জীবন উপভোগ করছে। বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখাচ্ছে। কোচিং করাচ্ছে দারুণ ভাবে। আর তার জন্য কোনও রকম টাকা নিচ্ছে না। এত ভাল ভাল কাজ করছে। আর পুরনো প্রসঙ্গ টেনে লাভ নেই। যখন কেউ খেলছে, তখন কথা বলার তাও একটা কারণ থাকে। গুরুত্ব থাকে। এখন তো আর তা নয়। ম্যাটার ইজ ওভার।”
কিন্তু ছাইচাপা আগুন ঢাকা থাকার কথা নয়। থাকছেও না। রাঁচীর যুবকের প্রতি গনগনে রাগ থেকেই গিয়েছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের প্রসঙ্গতেই যেন তীব্র অরুচি। সাফ বলেই দিলেন, “আমি ওই লোকটার নামই শুনতে চাই না। ব্যাস! আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টক অ্যাবাউট হিম।” না বলেই যেন বলে দিলেন অনেক কথা। উগরে দিলেন তীব্র ক্ষোভ।
ধোনিকে পাশে পাননি বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যুবরাজ। —ফাইল চিত্র।
এমএসডি-কে যেন গ্যালারির বাইরে আছড়ে ফেলই ফিরলেন কোচ যুবিতে। বললেন, “যে খেলা এত কিছু দিয়েছে, সেই খেলাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছে আমার ছেলে। বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখাচ্ছে। শুভমন গিলদের পাঁচ ঘণ্টা ধরে প্র্যাকটিস করাচ্ছে নিখরচায়। দেখুন, এই হল মানুষ। রিহ্যাব করাচ্ছে, প্র্যাকটিস করাচ্ছে, চণ্ডীগড়ে নিজের বাড়িতে দুটো বাচ্চাকে রেখেও দিয়েছে। এগুলো ভাল মানুষের কাজ। আমর উপর আশীর্বাদ রয়েছে নিশ্চয়ই, তাই আমার ছেলে এত মহান। আর যখন মহানদের কথা আলোচিত হয়, তখন ফালতু লোকদের নামও উচ্চারণ করতে নেই!”
কে মহান, কে ফালতু, ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন! নাম না করেও ফের এসে গেলেন এমএসডি। যেন চোখের সামনে রাঁচীর যুবককে দেখতে পাচ্ছেন যোগরাজ।
আরও পড়ুন: লকডাউনে ফিকে অলিম্পিকের স্বপ্ন, দেশকে প্রথম সোনা এনে দেওয়া স্বপ্নার সঙ্গী এখন কটূক্তি
আর তাই মেলে ধরলেন ক্রিকেটার যুবরাজকে। কোথায় অনন্য ছেলে, পেশ করলেন যুক্তি। যাতে মিশে গেল আবেগও। বললেন, “যুবরাজ সিংকে যে সংস্কার আমরা দিয়েছি, তার জন্যই ও দেশের হয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। শুধু খেলেইনি, নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছে। যা কেউ করে না। ক্যানসারের যন্ত্রণা সহ্য করেও দেশের হয়ে খেলেছে। এর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। কত পুরস্কার পেয়েছে ও। কখনও বলা হয়েছে সিক্সার কিং, কখনও বলা হয়েছে ম্যাচ উইনার। দেশের জন্য প্রাণ হাতে নিয়ে খেলেছে। আমার মনে হয়, যুবির সঙ্গে এই কারণেই দুনিয়ার কারও তুলনা হওয়া উচিত নয়। বাকি সবার চেয়ে ও আলাদা।”
কিন্তু অপ্রাপ্তি কি কিছুই নেই? সাদা বলের ক্রিকেটে যত ঝলমলে কেরিয়ারই থাক, লাল বলের ক্রিকেটে নিয়মিত হতে পারেননি। বিদায়বেলাও হয়নি স্মরণীয়। বাবা যদিও তা মনে রাখতে চাইছেন না। সোজাসুজি বললেন, “যুবরাজ সিংহ এক জন লিজেন্ড। আমি কারও সঙ্গেই ওর তুলনা করতে পারছি না। ও স্যার গারফিল্ড সোবার্স আর ভিভিয়ান রিচার্ডসের মিশ্রণ। ওকে উপরওয়ালা ব্যাট হাতে কবিতা লিখতে পাঠিয়েছেন। গ্রেগ চ্যাপেল এক বার ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওর ব্যাটিং দেখে বলেছিলেন যে, যুবি ব্যাট করলে তা গারফিল্ড সোবার্সের মতো দেখায়। এর চেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট হয় না। যদি সোবার্স এখনকার মতো ওয়ানডে ম্যাচ পেতেন, তবে ২৫ হাজার রান করে ফেলতেন। তাই সোবার্সের সঙ্গে যদি তুলনা হয়, যদি রিচার্ডসের কথা মনে হয় ওকে দেখে, তবে তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি কিছু হতে পারে না।”
ক্রিকেটার যুবি। কোচ যুবি। মানুষ যুবি। কে সেরা? যোগরাজ তুলনায় যান না। বরং ভেসে আসে প্রশান্তির হাসি।