অপেক্ষা: টেস্ট ফাইনালের লড়াই দেখতে মুখিয়ে সচিন। ফাইল চিত্র।
আর দু’দিন পরেই শুরু প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল। সাউদাম্পটনে ঐতিহাসিক ম্যাচে মুখোমুখি বিরাট কোহালির ভারত ও কেন উইলিয়ামসনের নিউজ়িল্যান্ড। কারা এগিয়ে? ইংল্যান্ডের পরিবেশে ব্যাটসম্যানের সফল হওয়ার মন্ত্র কী? সব প্রশ্নের জবাব নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সচিন তেন্ডুলকর। নির্বাচিত অংশ...
প্রশ্ন: টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে কারা এগিয়ে থাকবে বলে মনে হয়?
সচিন তেন্ডুলকর: ভারতীয় হিসেবে অবশ্যই এগিয়ে রাখতে চাইব ভারতকে। তবে নিরপেক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে যদি বিচার করি, তা হলে বলব, দু’টো দলই শক্তিশালী। দারুণ ভারসাম্য রয়েছে দু’দলে। উপভোগ্য লড়াই দেখতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্ব।
প্র: নিউজ়িল্যান্ড ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ খেলেছে, জিতেছে। ভারতীয় দলের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যে-হেতু খুব বেশি দিন হাতে পাননি বিরাট কোহালিরা অনুশীলনের জন্য। আপনি একমত?
সচিন: সিরিজগুলো তো আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। তাই সূচি নিয়ে সম্ভবত কারও কিছু করার ছিল না। আগে পৌঁছে যাওয়ার জন্য নয়, এমনিতেও নিউজ়িল্যান্ডের কাছে ইংল্যান্ডের পরিবেশ বেশি পরিচিত কারণ ওদের নিজেদের দেশের সঙ্গেও অনেকটা মিল রয়েছে। এই ফাইনালটাই যদি উপমহাদেশের কোথাও হত, শ্রীলঙ্কায় হত, তা হলে ভারতীয়রা বেশি পরিচিত থাকত সেই পরিবেশ নিয়ে। কিন্তু ভারতের এই দলটায় প্রায় সকলেরই ইংল্যান্ডে খেলার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। হয় জাতীয় দলের হয়ে, নয়তো ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে। তাই সম্পূর্ণ অচেনা দেশ নয় কারও কাছে। দেরিতে পৌঁছনোর জন্য আমি অন্তত ভারতীয় দলকে পিছিয়ে রাখছি না।
প্র: এই ফাইনাল জিততে গেলে ভারতকে কী কী সঠিক ভাবে করতে হবে?
সচিন: খুব গুরুত্বপূর্ণ টেস্টের প্রথম দুই ঘণ্টা। ব্যাটিং করি বা বোলিং, শুরুটা ভাল হওয়া দরকার। ব্যাটিংয়ে পার্টনারশিপ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। ব্যাটিং দেখে যেন মনে হয়, শক্তিশালী দল খেলছে। মজবুত ব্যাটিং করতে হবে। টেস্ট ফাইনাল, তাই কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। বোলিংয়ে তীব্রতা রেখে যেতে হবে। ফিল্ডিংয়েও সজাগ থাকতে হবে। হাতের ক্যাচ ফেলে দিয়ে আশা রেখো না যে, আবার ও ক্যাচ দেবে!
প্র: ভারতের এই ব্যাটিং গ্রুপ ইংল্যান্ডের পরিবেশে অতীতে সমস্যায় পড়েছে। আপনার পরামর্শ কী?
সচিন: আমার পরামর্শ হচ্ছে, বল যখন নড়াচড়া করছে, যতটা সম্ভব শরীরের কাছ থেকে খেলো। যতটা দেরিতে সম্ভব খেলো। এবং, ফ্রন্টফুটে জমাট রক্ষণ থাকতে হবে। সামনের পায়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে অনেক সময় শরীর থেকে দূরে খেলে ফেলে। সেই কারণে শরীরের কাছ থেকে খেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্র: ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় সফল হওয়ার জন্য এক জন ব্যাটসম্যানের আদর্শ পরিকল্পনা কী হতে পারে?
সচিন: খুব দ্রুত আবহাওয়া পাল্টে যেতে পারে ইংল্যান্ডে। পরিবেশকে সম্মান দিতে হবে। আকাশ যখন মেঘলা, বল বেশি সুইং-সিম করছে, তখন রক্ষণে মন দাও। মাথার উপরটা আবার রোদ ঝলমলে হয়ে উঠলে তুমিও স্ট্রোক খেলা শুরু করো।
প্র: সাউদাম্পটনের কিউরেটর জানিয়েছেন, পিচে পেস-বাউন্স থাকবে। শেষ সফরে মইন আলি কিন্তু ছয় উইকেট নিয়ে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। টেস্ট ফাইনালে কি তা হলে গতির যুদ্ধ হবে?
সচিন: দু’টো দলেই কিন্তু দারুণ পেসার রয়েছে। যারা সঠিক লাইন-লেংথে বল করতে পারবে, তারা বেশি সফল হবে। দলের কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকলে, সেটাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। কিউরেটর যদি পেস-বাউন্স থাকবে বলেন, তো ঠিক আছে। সেটা দু’টো দলের জন্যই সমান থাকবে। আমার মনে হয়, গতি বা বাউন্সের চেয়েও ইংল্যান্ডে সুইং খেলা নিয়ে ব্যাটসম্যানদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের ব্যাটসম্যানেরা গতি, বাউন্স মোকাবিলা করছে সারা পৃথিবীর উইকেটে। কিন্তু সব ব্যাটসম্যানের কাছেই বেশি চ্যালেঞ্জিং ভাল সুইং খেলা। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের পরিবেশে।
প্র: নিউজ়িল্যান্ডের হাতে ট্রেন্ট বোল্টের মতো বাঁ হাতি সুইং বোলার আছে। কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন বোল্ট?
সচিন: ট্রেন্ট বোল্ট খুবই অভিজ্ঞ এবং চতুর বোলার। কী ভাবে পরিবেশকে কাজে লাগাতে হয়, খুব ভাল করে জানে। নিজের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। খুব ‘স্মার্ট’ বোলার। ওর মতো বাঁ হাতি বোলারের বিরুদ্ধে আলাদা প্রস্তুতি দরকার। আমি নিশ্চিত আমাদের ছেলেরা সেই প্রস্তুতি নিয়েই ফাইনাল খেলতে নামবে। তা ছাড়া, বোল্ট তো অজানা কোনও প্রতিপক্ষ নয়। আগেও অনেক বার ওকে খেলেছে সবাই। তবু আমি বলতে চাই, ট্রেন্ট বোল্ট বিশ্বের সেরা বোলারদের এক জন। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সতর্ক থাকতে হবে।
প্র: ফাইনাল ড্র হলে যুগ্মবিজয়ী ঘোষণা করা হবে বলে আইসিসি জানিয়েছে। আপনার কী মত? যুগ্মবিজয়ী হওয়া উচিত না কি এমন কোনও প্রক্রিয়া থাকা উচিত যাতে একজন চ্যাম্পিয়ন বেছে নেওয়া সম্ভব হয়?
সচিন: যুগ্মবিজয়ী ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে। আশা করব, সাউদাম্পটনে এমন একটা বাইশ গজ দেওয়া হবে যেখানে ফলাফল হবে। যাতে যুগ্মবিজয়ী ব্যাপারটা এড়ানো সম্ভব হয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এক জন বিজয়ীই হওয়া উচিত।
প্র: যুগ্মবিজয়ী না করে এক জন বিজয়ী বেছে নেওয়ার জন্য কী করা যেতে পারত?
সচিন: আমার মতে, যদি পাঁচ দিনে টেস্ট শেষ না হয়, তা হলে চালিয়ে যাও। এত দিন ধরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রক্রিয়া চলার পরে ফাইনাল হচ্ছে। ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত অনেক আগের দিনের মতো ‘টাইমলেস টেস্ট’ করাই যেত। পিচ যদি ফলাফল দেওয়ার মতো হয়, পাঁচ দিনে শেষ হয়ে যেতেই পারে। তা হলে তো মিটেই গেল। না হলে একটা-দু’টো দিন বেশি চলল। তাতে মনে হয় এক জন বিজয়ীকে বেছে নেওয়া যেত। আমার মনে হয়, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের পরে এক দল চ্যাম্পিয়ন, অন্য দল রানার্স থাকা উচিত।
প্র: টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ‘বেস্ট অব থ্রি’ করার কথা উঠেছে। আপনার মত কী?
সচিন: ফাইনালে যে দু’টো দল উঠেছে, তারা কিন্তু আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন সিরিজ খেলে এই জায়গাটায় এসেছে। সব সিরিজই হয়েছে কমপক্ষে দুই টেস্টের। তিন, চার বা পাঁচ টেস্টের সিরিজও খেলা হয়েছে। হঠাৎ ফাইনালে এসে দেখা যাচ্ছে, মাত্র একটাই টেস্ট। আমার মত হচ্ছে, এ ব্যাপারে ধারাবাহিকতা আনা দরকার। ফাইনালটা তাই ‘বেস্ট অব থ্রি’ করার কথা ভাবা উচিত। যদি প্রথম দু’টো টেস্টেই চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয়ে যায়, তা হলে তৃতীয় ম্যাচের দরকার পড়ছে না। আর যদি ঠাসা ক্রীড়াসূচির মধ্যে সময় বের করা কঠিন হয়, তা হলে আইসিসির উচিত নিয়মটা পাল্টানো। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সিরিজের একটিই টেস্টের ফলাফলকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আওতায় রাখা হোক। এবং, আইসিসি আগে থেকে জানিয়ে দিক, কোন টেস্ট ম্যাচটা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মধ্যে ধরা হচ্ছে। ধরা যাক, চারটি টেস্টের সিরিজ হচ্ছে। আইসিসি বলে দিল, চতুর্থ টেস্টটা চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্টের জন্য ধরা হবে। বাকিটা এমনি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হিসেবে গণ্য হোক। যেমন ধরুন, আমরা অস্ট্রেলিয়ায় চারটি টেস্ট খেলেছি। দেশের মাটিতে এর পরে ফের চার টেস্টের সিরিজ খেললাম। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে মাত্র একটা টেস্ট। এটা নিয়ে সত্যিই ভাবা দরকার।