বাংলার কোচ অরুণ লাল। ছবি: ফাইল চিত্র।
বাংলার এমন কঠিন সময়ে কোচের দায়িত্ব নিলেন কেন?
অরুণ: বাংলা ক্রিকেট থেকে আমি সবকিছু পেয়েছি। তাই বাংলা ক্রিকেটের প্রতি সর্বদাই আমি কৃতজ্ঞ। আমার মনে হয় বাংলার ক্রিকেটের প্রতি আমার কিছু দায়িত্বও রয়েছে। তাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন আমাকে বাংলার কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেয় তখন আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনি।
বাংলা ক্রিকেটকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন? কোন পথে হাঁটলে সাফল্য আসবে?
অরুণ: আমি কিছু প্ল্যান করিনি। আগে থেকে সাফল্যের গ্যারান্টি দিতে পারব না। তবে আমার মনে হয় মূলত ফিটনেসে আমরা অন্য রঞ্জি দলগুলির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলাম। যার প্রভাব আমাদের খেলার মধ্যেও পড়ছিল। আমি চাই ছোটবেলা থেকেই সব ধরনের ক্রিকেটে যেন ফিটনেসের উপরে জোর দেওয়া হয়। ছোটবেলা থেকেই যদি ফিটনেসের উপরে জোর দেওয়া হয়, তা হলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে ফিটনেস নিয়ে খাটতে হয় না। বিরাট কোহালি আমাদের সবার কাছেই অনুপ্রেরণা। কোহালি ফিটনেসকে কতটা গুরুত্ব দেয়, তা সবাই জানে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওর সাফল্যই প্রমাণ করে দেয় এখনকার সময়ে ভাল পারফর্ম করতে হলেফিটনেস কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এর থেকেই কি ইয়ো- ইয়ো টেস্টের কথা মাথায় আসে?
অরুণ: না, না। রাজস্থানের মতো দলে অনেক আগে থেকেই এই পরীক্ষা হয়। আপনি কতটা ফিট সেটা বুঝতে সাহায্য করে ইয়ো ইয়ো টেস্ট। ক্রিকেটাররা প্রচুর ট্রেনিং করে। কিন্তু বাকিদের তুলনায় একজন ক্রিকেটার কতটা ফিট, সেটা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। ইয়ো ইয়ো টেস্ট আপনাকে সেটা জানতেই সাহায্য করে। নিজের ফিটনেস আপনি জানতে পারবেন।
অভিমন্যু ঈশ্বরনের মত তরুণ ক্রিকেটারকে অধিনায়ক করার পিছনে কারণ কী? এর মধ্যে দিয়ে কি বলা যায় বাংলার কোচ তরুণদের উপরেই আস্থা রাখছেন?
অরুণ: দেখুন, মনোজ তিওয়ারি বহুদিন ধরে দলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বাংলার ক্রিকেট ওর কাছে চির কৃতজ্ঞ। কিন্তু, সময় এসেছে সামনের দিকে তাকানোর। আমাদের মনে হয়েছে এটাই সেরা সময় অভিমন্যুর মত একজন তরুণের হাতে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়ার। এর ফলে মনোজ ওকে অধিনায়কত্বের খুঁটিনাটি বিষয়েপরামর্শ দিতে পারবে। ভবিষ্যতে অভি বাংলার সফলতম অধিনায়কও হয়ে উঠতেই পারে।অভিমন্যু প্রচণ্ড ফিট। ভারত এ দলের হয়ে দলীপ ট্রফিতে দুর্দান্ত খেলেছে অভিমন্যু। বিরাটের মতোই দলের সবার জন্য ও উদাহরণ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, মানুষ হিসাবেও ও খুব ভালো। ঈশ্বরনের সম্পর্কে কেউ কখনও খারাপ কিছু বলবে না। ওর মতো একজন তরুণকে অধিনায়ক হিসেবে পেয়ে আমি খুশি। আমার মতে, চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ও পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে।
দলে মনোজ তিওয়ারি, অশোক দিন্দাদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের গুরুত্ব কতটা?
অরুণ: ওদের অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প হয়না। ক্রিকেট পুরোটাই মানসিক খেলা। কঠিন সময়ে ওদের অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগানোর দরকার। বহুদিন ধরে খেলার ফলে চাপের মুখে ওরা ভেঙে পড়ে না। দিন্দা বা মনোজ বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা দু’ জন ক্রিকেটার। সুতরাং, দলে ওদের উপস্থিতিই আমাদের কাছে খুব মুল্যবান।
ভবিষ্যতে হয়তো ঈশান পোড়েলকে দলের বোলিং বিভাগের নেতৃত্বে দেখা যাবে। ঈশানকে নিয়ে আপনার কি মত?
অরুণ: ঈশান দারুন প্রতিভা। ওর বয়স এখনও খুবই কম। তাই ওর সঠিক পরামর্শের প্রয়োজন। টিম ম্যানেজমেন্ট ওকে নিয়ে খুবই আশাবাদী।ঈশানের প্রতিভার জোরেই ও এখন ভারতের এ দলের হয়ে খেলছে এবং ভাল পারফর্মও করছে। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে ওকে শুধু বাংলাই নয়, জাতীয় দলের জার্সি গায়েও দেখা যাবে।
ইডেন গার্ডেন্সের পিচ ফাস্ট বোলারদের সাহায্য করে। এমনকি কেকেআর-ও তাদের রণনীতি বদলে ফাস্ট বোলারদেরই বেশি সুযোগ দিচ্ছে। বাংলাও কি একই পথে হাঁটবে?
অরুণ: শুধু ফাস্ট বোলার নয়। একটা ম্যাচ জিততে স্পিনার, ফাস্ট বোলার, অলরাউন্ডার, ব্যাটসম্যান সবার দরকার। সবাই মিলে পারফর্ম করলে তবেই সাফল্য আসে। তবে হ্যাঁ, দু-তিনটে ভাল ফাস্ট বোলার দলে থাকলে জেতার সম্ভাবনা অবশ্যই বেড়ে যায়।
আপনার পছন্দের কম্বিনেশন কী?
অরুণ: পিচ অনুযায়ী সবসময় দল নির্বাচন করা দরকার। তবে আমি চার বোলারএবং এক অলরাউন্ডার নিয়ে খেলতে পছন্দ করি এবং একজন ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার। এর ফলে অধিনায়কের হাতে পাঁচটি বোলিং অপশনও হয়ে যায়। এখনকার ক্রিকেটে শুধু বল করতে পারলেই হবে না। দলের প্রয়োজনে বোলারদেরও ব্যাট হাতে রান করতে হবে। ঈশান পোড়েল, দিন্দা, মুকেশদের ব্যাট খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ঘরোয়া ক্রিকেট বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন প্রায় সব দলের বোলাররাই ব্যাট হাতে দলের হয়ে অবদান রাখে। আমার বিশ্বাস বাংলাও এ দিকটায় উন্নতি করবে।
বহুদিন হয়ে গেল বাংলা থেকে ভাল স্পিনার উঠে আসছে না। এর কারণ কী? আপনার কী মনে হয়?
অরুণ: ভাল স্পিনারের অভাব শুধু বাংলা নয়, ভারতেও দেখা যাচ্ছে। সত্যি বলতে, বোর্ড যে ধরণের পিচ তৈরি করছে, তা একদমই স্পিন সহায়ক নয়। ম্যাচের চতুর্থ দিনেও পিচ থেকে স্পিনাররা কিছুই সাহায্য পাচ্ছে না। একটা ভাল পিচ ম্যাচের প্রথম দিন ফাস্ট বোলারদের সাহায্য করবে, পরের দু’ দিন ব্যাটসম্যানদের এবং শেষের দু’ দিন স্পিনারদের জন্য সহায়ক হবে। এছাড়া দিন দিন মাঠের বাউন্ডারিও ছোট হচ্ছে। যা স্পিন বোলারদের কোনোভাবেই সাহায্য করছে না। এ বিষয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কথাও বলেছি।
প্রয়াস রায়বর্মন বাংলার ক্রিকেটে উদীয়মান প্রতিভা। গত বছর আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর চড়া দামে তাঁকে দলে নেয়। ওঁর কাছ থেকে আপনার প্রত্যাশা কী?
অরুণ: ও দলে সুযোগ পেলে অবশ্যই ওর থেকে কিছু আশা থাকবে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই দল গঠন করা হবে। প্রয়াসের বয়স খুবই কম। ওর গাইডেন্সের প্রয়োজন। প্রয়াস যদি নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারে, তা হলে বাংলা-সহ দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।
কেকেআর বাংলা ক্রিকেটাদের দলে নিতে বেশি আগ্রহ দেখায় না বলে প্রায়ই শোনা যায়। বাংলার ক্রিকেটাররা কি কেকেআর-এ সুযোগ পাওয়ার মতো দক্ষ নয়?
অরুণ: এটা খুবই দুঃখজনক যে বাংলা থেকে ক্রিকেটাররা তাঁদের ঘরের দলে সুযোগ পাচ্ছে না। তবে সত্যি বলতে, একটা দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়। দলের কী দরকার, কেমন ধরনের ক্রিকেটার দল চাইছে, সেই সব মাথায় রেখেই দল গঠন করা হয়। তবে বাংলা ক্রিকেটে প্রচুর ভাল ক্রিকেটার আছে। আশা করি, আগামী দিনে বাংলার ক্রিকেটারদের কেকেআর-এর জার্সি গায়ে মাঠে নামতে দেখা যাবে।
অরুণ লাল এবং ঋদ্ধিমান সাহা। ছবি: ফাইল চিত্র।
ভারতীয় দলে উইকেটরক্ষক নিয়ে টালবাহানা চলছেই। ঋষভের উপর আস্থা রেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। শুরুটা ভাল করেও ফর্ম ধরে রাখতে ব্যর্থ ঋষভ। শোনা যাচ্ছে আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে হয়তো আবার উইকেটের পিছনে বাংলার ঋদ্ধিকেই দেখা যাবে। আপনার পছন্দ কে?
অরুণ: আমি সবসময়ই ঋদ্ধিকেই দলে রাখতাম। উপমহাদেশের পিচে উইকেটের পিছনে সব সময়ে ভাল কিপারের প্রয়োজন হয়। আমার মতে, ঋদ্ধি শুধু ভারতেরই নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা কিপার। ঋদ্ধি যদি জাতীয় দলে প্রথম এগারোয় সুযোগ না পায়, তা হলে তা বিস্ময়কর। ঋষভ খুবই প্রতিভাবান। তবে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ ও আরও পাবে। এখনকার জন্য আমি ঋদ্ধিকেই এগিয়ে রাখব। ঋদ্ধিকে দলে রাখলে অনেক দিক থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে। ঋদ্ধির ব্যাটিং খুব ভাল। কঠিন সময়ে দলকে নির্ভরতা দিতে পারবে ঋদ্ধির ব্যাটিং। তা ছাড়া দেশের মাটিতে টার্নিং ট্র্যাকে কিপিং করা খুব কঠিন। স্কিলের দরকার হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমার তো মনে হয় ঋদ্ধিকেই সুযোগ দেওয়া উচিত।
সবশেষে একটাই প্রশ্ন আপনার কাছে। এ মরসুমে বাংলার লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
অরুণ: শুধু এ মরসুম নয়, আমি বাংলা ক্রিকেটকে সবসময়েই দেশের প্রথম সারির দলগুলির মধ্যে দেখতে চাই। বাংলাকে আপাতত বাকি রঞ্জি দলগুলির সমকক্ষ করে তোলাই আমার লক্ষ্য।
আরও পড়ুন: ‘জাতীয় দলে ডাক পেলে যে কোনও জায়গায় ব্যাট করতে প্রস্তুত’
আরও পড়ুন: বিরাটদের থামাতে ভারতীয় ব্যাটিং পরামর্শদাতা নিয়োগ করল দক্ষিণ আফ্রিকা