আগমন: রিয়ালে পৌঁছে গেলেন লোপেতেগি।
দীর্ঘদিন ধরে আমি স্প্যানিশ ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। লা লিগায় (স্প্যানিশ ফুটবল লিগ) চাকরি করছি অনেক বছর। কিন্তু এই রকম ধাক্কা কোনও দিন খাইনি। আমরাও ভাবতে পারিনি বিশ্বকাপের দু’দিন আগে য়ুলেন লোপেতেগি-কে নিয়ে এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে। লা লিগারই একটা ক্লাব তুলে নেবে স্পেনের জাতীয় কোচকে।
স্প্যানিশ সমর্থক বা সাংবাদিকদের কথা ছেড়েই দিন। আমরা খোদ লা লিগার লোক। আমরাই জানতাম না, ভিতরে ভিতরে রিয়াল মাদ্রিদ এ ভাবে লোপেতেগিকে কোচ বানিয়ে দেবে। আপনাদের একটা খবর বলছি। জ়িনেদিন জ়িদান সরে যাওয়ার পরে রিয়ালের বিকল্প কোচের তালিকায় য়ুর্গেন ক্লপ, ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি ছাড়া আর দু’ একটা নাম ছিল। কিন্তু কখনওই লোপেতেগি-কে ওরা প্রাথমিক ভাবে কোচ হিসেবে ভাবেনি। ফলে রিয়াল যখন কোচ হিসেবে লোপেতেগির নাম ঘোষণা করল, গোটা বিশ্বের মতো আমরাও চমকে উঠেছিলাম।
আমি এখন বার্সেলোনায়। কিন্তু এত দূরে বসেও স্পেন শিবিরের ভূকম্পন টের পাচ্ছি। বুধবার সকালে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন সরকারি ভাবে লোপেতেগি-কে সরিয়ে দিলেও মঙ্গলবার রাত থেকেই শিবিরের ফুটবলাররা জেনে যান, কী ঘটতে চলেছে। বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কারণ, স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেসের কাছে ওই পরিস্থিতিতে লোপেতেগি-কে সরানো ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। শুধু ফেডারেশনের মধ্যেই নয়, স্প্যানিশ ফুটবলারদের মধ্যেও লোপেতেগি-কে নিয়ে একটা ধারণা জন্ম নেয়— ওই লোকটা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
চার বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপে বিপর্যয়ের পরেই ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দু’বছর আগে ইউরো কাপের শেষে ভিসেন্তে দেলবস্কি সরে যান। তার পরে স্পেনের কর্তারা লোপেতেগি-কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নতুন করে দলটাকে গড়ার। পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বলা হয়েছিল, আপনি যা চান, পাবেন। শুধু দলটাকে ঠিক মতো তৈরি করুন। তিকিতাকার ছন্দের সঙ্গে ডাইরেক্ট ফুটবলের মিশেল ঘটিয়ে ঠিক দিকেই এগোচ্ছিলেন লোপেতেগি। যোগ্যতা অর্জন পর্বে স্পেন দশটা ম্যাচে ন’টা জয় পেয়েছিল, একটা ড্র। তাই ওঁর এই সিদ্ধান্তটা বেশি আঘাত দিয়েছে।
এই অবস্থায় আজ, শুক্রবার পর্তুগালের বিরুদ্ধে মহারণ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করছে স্পেন। স্পেনের এই দলটায় যাঁরা প্রধান ফুটবলার, সেই আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, জেরার পিকে, ইয়র্ডি আলবা, সের্খিয়ো র্যামোসদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ওঁদের খুব ভাল করে চিনি। জানি, একবার রেফারির বাঁশি বেজে গেলে সব কিছু ভুলে নিজেদের সেরাটা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন ওঁরা। তবু যা ঘটনা ঘটে গেল, তার পর একটা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। এখানেই নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটা করতে হবে ইয়েরো-কে।
পর্তুগালের সঙ্গে এই ম্যাচে যিনি স্পেনের প্রধান কাঁটা হয়ে উঠতে পারেন, সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে আমাদের ফুটবলাররা খুব ভাল করে জানেন। ওঁকে আটকানোর রাস্তা র্যামোসদের জানা আছে। অনেকে হয়তো মনে করবেন, রিয়াল মাদ্রিদ ভক্তদের কাছে রোনাল্ডো ফুটবল ঈশ্বরের সমান। তা হলে স্পেনের বিরুদ্ধে খেলা হলে ওঁরা কি রোনাল্ডোর হয়ে গলা ফাটাবেন? আপনাদের একটা কথা বলে দিচ্ছি। রিয়াল কর্তারা এই রকম একটা ঘটনা ঘটালেও রিয়াল ভক্তরা কিন্তু স্পেনের হয়েই গর্জন করবেন। রিয়াল কর্তারা হয়তো স্পেন ম্যাচের ঠিক আগের দিন লোপেতেগি-কে রিয়াল দর্শকদের সামনে তুলে ধরলেন, কিন্তু খেলা শুরু হলে সমর্থন বিভাজনের কোনও প্রশ্ন থাকবে না। আর দেখবেন, র্যামোস যে রকম কড়া ফুটবল খেলেন, সে রকমই খেলবেন। রোনাল্ডোকে কড়া ট্যাকল করতে দু’বার ভাববেন না।
কোনও সন্দেহ নেই, এই পরিস্থিতিতে স্পেনের নতুন কোচ ফের্নান্দো ইয়েরোর কাজটা খুব কঠিন। আমি মনে করি, রণনীতি গড়ার ক্ষেত্রে নতুন কিছু তিনি করতে পারবেন না এই দু’দিনে। সেটা সম্ভবও নয়। ইয়েরোর আসল কাজটা হবে তারকাদের সামলানো।
কোচ হিসেবে ইয়েরোর খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু ফুটবলাররা ওঁকে খুব সম্মান করেন। ফুটবল জীবনে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দাপটে খেলেছেন। মহাতারকাদের কী ভাবে সামলাতে হয়, জানেন। এটা কিন্তু বড় সুবিধে হবে স্পেনের নতুন কোচের।
আরও একটা ব্যাপার ইয়েরোর পক্ষে যাবে। স্পেন যদি বিশ্বকাপে ভাল কিছু করে, ইয়েরো নায়ক হয়ে যাবেন। আর খারাপ কিছু হলে খলনায়ক হয়ে যাবেন লোপেতেগি!
(লেখক স্পেনের লা লিগার অডিয়ো ভিসুয়্যাল বিভাগের কন্টেন্ট ও প্রোগ্রামিংয়ের প্রধান)