নিজেকে বদলাতে চান কিরিয়স ছবি রয়টার্স
আপনি ওকে ভালবাসতে পারেন বা ঘৃণা করতে পারেন। কিন্তু উপেক্ষা করতে পারবেন না।
নিক কিরিয়স সম্পর্কে বহুল প্রচলিত এই কথাটি বার বারই বলে থাকেন টেনিস বিশেষজ্ঞরা। ঠিকই বলেন। কিরিয়স মাঠে নামলেই বিতর্ক। কিরিয়স মাঠে নামলেই মজার মুহূর্ত। কিরিয়স মাঠে নামলেই দুর্দান্ত কিছু রিটার্ন, কিছু দর্শনীয় শট। কিরিয়স মাঠে নামলেই আন্ডারআর্ম সার্ভ। সংক্ষেপে বললে, কিরিয়স যেন টেনিসের একটা ‘প্যাকেজ’। তাঁর ম্যাচ দেখতে আসা মানে কোনও না কোনও একটা অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে হবেই।
বয়স মাত্র ২৭। তবে মাঝেমাঝে এমন ধরনের কথা বলেন, মনে হয় পকেটে প্রচুর গ্র্যান্ড স্ল্যাম রয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে টেনিস খেলছেন, টেনিসের সব কিছু তাঁর শেখা, জানা হয়ে গিয়েছে। আদপে তা একেবারেই নয়। বস্তুত, এ বারের উইম্বলডনে সেমিফাইনালে ওঠা তাঁর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জীবনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। এর আগে তৃতীয় রাউন্ড, চতুর্থ রাউন্ড, বড় জোর কোয়ার্টার ফাইনাল। কোনও না কোনও বিতর্কের মাধ্যমে শেষ হয়ে যেত তাঁর দৌড়। কিরিয়স কি তা হলে নিজেকে বদলে ফেললেন?
সেটাই বা বলা যায় কী করে? এ বারের উইম্বলডনেই তো প্রথম ম্যাচে দর্শককে থুতু দেওয়ার অপরাধে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। তৃতীয় রাউন্ডে স্টেফানোস চিচিপাসের বিরুদ্ধে ম্যাচ উইম্বলডনের অন্যতম বিতর্কিত। এই যে তিনি সেমিফাইনালে উঠলেন, দেশ থেকে শুনতে পেয়েছেন খারাপ খবর। প্রাক্তন বান্ধবীকে নিগ্রহ করার অপরাধে পরের মাসেই অস্ট্রেলিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে হবে তাঁকে। প্রতিযোগিতার মাঝে সে দিকে একেবারেই মন দিতে চাইছেন না তিনি।
কিরিয়সকে নিয়ে এক সময় অনেক আশা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। প্রতি বারই আশাহত করেছেন তিনি। যখনই মনে হয়েছে এ বার তাঁর চূড়োয় ওঠার সময়, কোনও না কোনও বিতর্ক তাঁকে পিছু টেনে নামিয়েছে নীচে। সহজ ম্যাচ অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে হেরে বসেছেন। ম্যাচ নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এমন সব কাজ করেছেন, যাতে বিরক্ত হয়েছেন দর্শকরা। উড়ে এসেছে ব্যঙ্গাত্মক শিস। বড় মঞ্চে ম্যাচ জিততে যে ধরনের মানসিকতা বা শারীরিক সক্ষমতা দরকার, কোনও দিনই তাঁর ধারেকাছে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কিরিয়স। পাত্তাই দেননি। নিজের প্রতিভা অসীম, কোনও দিন তা মেলে ধরার চেষ্টা করেননি।
উচ্চতার কারণে ছোটবেলায় বাস্কেটবলই তাঁর প্রিয় খেলা ছিল। ১৪ বছর বয়সে টেনিসের প্রেমে পড়া। উচ্চতার জন্যেই জোরালো সার্ভ এবং কোর্ট কভারেজ বাকিদের থেকে অনেক বেশি। কোনও দিন নিজের শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেননি। তবু তাঁর প্রতিভাকে অস্বীকার করতে পারেননি, পারেন না কেউই। মাঝেমধ্যেই বিখ্যাত খেলোয়াড়দের হারিয়ে চমকে দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া মাত্রই পরের ম্যাচে অখ্যাত কারওর কাছে হেরে গিয়েছেন। যাঁরা তাঁর অনুরাগী বা খেলার খবর রাখেন, তাঁরা এ সব ঘটনার সঙ্গে এত দিনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। জীবনে যত অর্থ পুরস্কারমূল্য হিসাবে পেয়েছেন, তার অর্ধেকই বোধহয় জরিমানা দিতে খরচ হয়ে গিয়েছে। কখনও প্রতিপক্ষকে গালি দিচ্ছেন, কখনও আম্পায়ারের সঙ্গে ঝগড়া করছেন, কখনও দর্শকদের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন, কখনও ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে হেরে যাচ্ছেন, কখনও বোতল নিয়ে স্বমেহন করার মতো অশ্লীল আচরণ করছেন — তালিকা থামার নয়।
নাদালের বিরুদ্ধে শুক্রবার সেমিফাইনালে খেলতে নামবেন। এই নাদালকে হারিয়েই ২০১৪-র উইম্বলডনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন কিরিয়স। তাঁকে আগামীর তারকা বলা হচ্ছিল। সেই সুনাম রাখতে পারেননি। ওই ম্যাচের পর নাদালের ঘরে আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ঢুকেছে। কিরিয়স কোয়ার্টারের বেশি এগোতে পারেননি। বছর তিনেক আগেই নাদালের বিরুদ্ধে মেক্সিকোর আকাপুলকোতে মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই ম্যাচেও বিতর্কের ছড়াছড়ি। তিনটি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে নাদালকে হারালেও, কিরিয়সের আচরণ মোটেও পছন্দ হয়নি স্প্যানিশ তারকার। ম্যাচের পর স্পষ্ট বলে দেন, “ওর প্রচুর প্রতিভা। হয়তো কোনও দিন গ্র্যান্ড স্ল্যাম পাবে এবং অনেক কিছু অর্জন করবে। কিন্তু দর্শক, বিপক্ষ, এমনকি নিজের প্রতিও ওর কোনও শ্রদ্ধা নেই।” প্রসঙ্গত, নাদাল এবং জোকোভিচের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সাক্ষাতের ফল এই মুহূর্তে কিরিয়সের থেকে ভাল আর কারওর নেই।
ঘটনাচক্রে, চিচিপাসের সঙ্গে সেই বিতর্কের পর উইম্বলডনে ‘অন্য’ কিরিয়সকে দেখা যাচ্ছে। শেষ দু’টি রাউন্ডে তিনি ম্যাচ জেতার উপরেই জোর দিয়েছেন। বুধবার কোয়ার্টার ফাইনালে দু’ঘণ্টা ১৩ মিনিটের লড়াইয়ে ক্রিশ্চিয়ান গারিনকে হারিয়েছেন ৬-৪, ৬-৩, ৭-৬ গেমে। এখন তিনি ম্যাচ জিতলে বারে গিয়ে অকারণে মদ্যপান করেন না। রাত জেগে ভিডিয়ো গেমে বুঁদ থাকেন না। দীর্ঘ দিন ধরে যে উচ্চতায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন, সেই লক্ষ্যের দিকেই এখন ধাওয়া করছেন কিরিয়স। গারিনকে হারিয়ে কিরিয়স বলেছেন, “এখন শুধু আমি নই, আমার গোটা দলের লক্ষ্য একটাই। সেই দিকেই এগিয়ে চলেছি। ওদের জানিয়ে দিয়েছি, এ বার আমি সত্যি করে সাফল্য পেতে চাই। এমনকি, সম্ভব হলে ট্রফিটাও তুলতে চাই। তাই এখন বিশ্রাম আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”
পাঁচ সেটের লড়াইয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পরও নাদাল নিশ্চিত নন সেমিফাইনালে নামতে পারবেন কি না। যদি নামতে না পারেন, তা হলে বিনা যুদ্ধেই কিরিয়সের সামনে চলে আসবে ফাইনাল খেলার সুযোগ, যার অপেক্ষা করছিলেন বহু দিন। কাঙ্ক্ষিত ট্রফি কি হাতে উঠবে? বলে দেবে সময়।