অনূর্ধ্ব ১৯ যুব বিশ্বকাপে ভাল পারফরম্যান্স মানেই ভবিষ্যতের জাতীয় দলের ক্রিকেট তারকা, এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বারবর। ধূমকেতুর মতো উত্থানের পরেও বহু ক্রিকেটার হারিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন উন্মুক্ত চাঁদ।
উন্মুক্তের জন্ম ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ, এক কুমায়ুনি পরিবারে। তাঁর বাবা ভরতচাঁদ ঠাকুর এবং মা রাজেশ্বরী চাঁদ, দু’জনেই ছিলেন শিক্ষক। ডিপিএস নয়ডার পরে উন্মুক্তের পড়াশোনা সেখানকারই মডার্ন স্কুলে।
স্কুলজীবনেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম সুযোগ দিল্লি অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। লিস্ট এ ম্যাচে আত্মপ্রকাশ ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে। বিপক্ষ ছিল জম্মু কাশ্মীর। পরের মাসে প্রথমবার টি-২০ দলে সুযোগ পান। ম্যাচ হয়েছিল অসম বনাম দিল্লি। সে বছরই নভেম্বরে জম্মু কাশ্মীরের বিরুদ্ধে উন্মুক্তের অভিষেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচে।
ভাল পারফরম্যান্সের জোরে দিল্লি অনূর্ধ্ব ১৯ এবং পরে উত্তরাঞ্চল অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক হন উন্মুক্ত। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর সামনে আসে জাতীয় যুব দলে অধিনায়কত্বের সুযোগ।
২০১২-র এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ায় চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দল। ভারত-অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি প্রতিযোগী দেশ ছিল ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। উন্মুক্তের চওড়া ব্যাটের ৬৩ রানে ভর করে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ী হয় ভারত। ফাইনালে উন্মুক্তের অপরাজিত ১১২ রানের ইনিংস সাজানো ছিল ৯টা বাউন্ডারি এবং ৬টা ওভার বাউন্ডারি দিয়ে। ৭ উইকেট বাকি থাকতেই ম্যাচে জয়ী হয় ভারত। ৫ ম্যাচে ২৮১ রান করে উন্মুক্ত ছিলেন সেই সিরিজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী।
তাঁর নেতৃত্বেই অস্ট্রেলিয়ায় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলে ভারত। সেই প্রতিযোগিতায় কাপ এসেছিল ভারতেই। উন্মুক্তের অধিনায়কত্বে ভারত যুব বিশ্বকাপ জয়ী হয়। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের অন্যতম অনুঘটক ছিল উন্মুক্তের ইনিংস।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে উন্মুক্ত অপরাজিত ছিলেন ১১১ রানে। ১৩০ বলের বিনিময়ে করা সেই ইনিংসে ছিল সাতটা বাউন্ডারি এবং ছ’টা ওভার বাউন্ডারি। স্মিত পটেলের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দিতে ৭ উইকেটে জয়ী হয় ভারত।
এরপর ডানহাতি উন্মুক্তকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা। ধরেই নেওয়া হয়েছিল ভবিষ্যতে তিনিই শাসন করবেন জাতীয় দল। কিন্তু বাস্তবে বল গড়ায় সম্পূর্ণ বিপরীতে। জাতীয় দলের দরজা তো খোলেইনি, পরবর্তী সময়ে দিল্লির দল থেকেও বাদ পড়েন উন্মুক্ত।
অথচ এই দিল্লির হয়ে খেলার সময়েই সাহসিকতা নজির রেখেছিলেন উন্মুক্ত। ২০১৮ সালে বিজয় হাজারে ট্রফিতে উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিলেন উন্মুক্ত চাঁদ।
নেটে প্র্যাকটিসের সময়ই চোট পেয়েছিলেন উন্মুক্ত। ওই চোট নিয়ে খেলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু পিছিয়ে যাননি উন্মুক্ত। ভাঙা চোয়ালে ব্যান্ডেজ বেঁধেই ব্যাট করতে নামেন দিল্লির ওপেনার। তাঁর সেঞ্চুরিতেই ৫৫ রানে উত্তরপ্রদেশকে হারিয়ে দেয় দিল্লি। ৫০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ৩০৭ রান করে দিল্লি। উন্মুক্ত চাঁদ ১২৫ বলে ১১৬ রানের ইনিংস খেলেন। যে ইনিংস সাজানো ছিল ১২টি বাউন্ডারি ও তিনটি ওভার বাউন্ডারি দিয়ে।
একইভাবে ভাঙা চোয়াল নিয়ে ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অ্যান্টিগায় খেলেছিলেন অনিল কুম্বলে। উন্মুক্ত চাঁদের এই চোয়াল ভাঙা ইনিংস সেই সময়কে আবার ফিরিয়ে আনে ভারতীয় ক্রিকেটে। এর পর উন্মুক্ত চাঁদের সেই ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসায় ভরে যায়।
আইপিএল-এও খেলেছেন উন্মুক্ত। ২০১১ সালে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-এর হয়ে তাঁর আইপিএল অভিষেক হয়। কিন্তু অনূর্ধ্ব ১৯ স্তরের নিজের পারফরম্যান্সের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেননি।
পরে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়্যালস এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্স-এর হয়ে খেলেছেন। ২০১৫ সালে তাঁকে প্রায় গোটা প্রতিযোগিতাই কাটাতে হয় বেঞ্চে ধারে। তাঁকে বিশেষ খেলার সুযোগ দেয়নি মুম্বই ইন্ডিয়ান্স।
কেন তাঁর কেরিয়ার এ ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল? উত্তর নেই বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের কাছেও। এক সময় তাঁর তুলনা হত বিরাট কোহালির সঙ্গে। কিন্তু তিনি নিজে কোনও তুলনায় যেতে চান না। নিজেকেই নিজের মাপকাঠি বলে মনে করেন। মাঝে মাঝেই সেই বার্তা পোস্ট করেন তিনি। কেরিয়ারে হোঁচট খেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি খুবই সক্রিয়। সেখানে তাঁর ঝা চকচকে প্রোফাইলে কেরিয়ার নিয়ে হতাশার কোনও লক্ষণ নেই।
২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে উন্মুক্তের আত্মজীবনী, ‘দ্য স্কাই ইজ দ্য লিমিট’। বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন রাহুল দ্রাবিড়, ভি ভি এস লক্ষ্মণ এবং সঞ্জয় মঞ্জরেকর। (ছবি: আর্কাইভ এবং ফেসবুক)