যন্ত্রণা নিংড়ে শহরে বিরাট বিস্ফোরণ

বিরাট কোহলিকে আর থামানো যাচ্ছিল না। এত দিন লোককে বলতে দিয়েছেন। নিরন্তর রক্তাক্ত হয়েও কাউকে বলতে যাননি নিজের যন্ত্রণার কথা। দেশের সমর্থকদের একটা অংশ যখন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারত-বিদায়ের জন্য তাঁর প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মাকে কদর্য ভাবে দায়ী করেছে, ‘অপয়া অনুষ্কা সেমিফাইনাল দেখতে গিয়েছিলেন বলেই ভারত হারল’ বলে টিটকিরি দিয়েছে— কোথাও টুঁ শব্দও তো করেননি বিরাট! এক-একটা করে দিন এগিয়েছে কাপ সেমিফাইনালের পর। দুঃখ পেয়েছেন। ভেবে অবাক হয়েছেন, লোকে এ ভাবেও বলতে পারে! মনে হয়েছে, এ বার অন্তত কিছু বলি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

বিরাট কোহলিকে আর থামানো যাচ্ছিল না।

Advertisement

এত দিন লোককে বলতে দিয়েছেন। নিরন্তর রক্তাক্ত হয়েও কাউকে বলতে যাননি নিজের যন্ত্রণার কথা। দেশের সমর্থকদের একটা অংশ যখন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারত-বিদায়ের জন্য তাঁর প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মাকে কদর্য ভাবে দায়ী করেছে, ‘অপয়া অনুষ্কা সেমিফাইনাল দেখতে গিয়েছিলেন বলেই ভারত হারল’ বলে টিটকিরি দিয়েছে— কোথাও টুঁ শব্দও তো করেননি বিরাট! এক-একটা করে দিন এগিয়েছে কাপ সেমিফাইনালের পর। দুঃখ পেয়েছেন। ভেবে অবাক হয়েছেন, লোকে এ ভাবেও বলতে পারে! মনে হয়েছে, এ বার অন্তত কিছু বলি।

বলা হয়নি তখন। তবে অস্ট্রেলিয়া-ফেরত মুম্বই এয়ারপোর্টে বেরিয়েছেন অনুষ্কারই হাত ধরে। আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতায় নেমে দু’জন দু’দিকে যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরেছেন অনুষ্কাকে। নীরবে বুঝিয়েছেন, ‘যে যা খুশি বলুক আমি তোমার সঙ্গে আছি।’

Advertisement

এক পক্ষকাল ধরে তাঁর প্রতিবাদের ভাষা নীরব ছিল। শুক্রবার সেটাই বদলে গেল গর্জনে।

“লোকে যে ভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষত অনুষ্কাকে টেনে আনছিল, সেটা অত্যন্ত অসম্মানের।
আমাদের হারের জন্য অনুষ্কাকে যে ভাবে দায়ী করা হচ্ছিল, তা-ও দুঃখজনক।
একটা হারের পর যারা এমন করে, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত।” —বিরাট কোহলি

আর সেই গর্জন এতটাই কানফাটানো যে, সেটা তাঁর সমালোচকদের অন্তত সাময়িক বধির করে দেওয়ার পক্ষে বোধহয় যথেষ্ট! কখনও টিম হোটেল, কখনও ইডেন। কখনও সকাল সাড়ে বারোটায়, কখনও বিকেল পাঁচটায়। গর্জনের স্থান-কালটা শুধু পাল্টাল। কোথাও সঞ্চালককে থামিয়ে দিলেন ‘আমি প্রশ্নের উত্তরটা দেব’ বলে। কোথাও আবার নিজেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে বললেন, ‘‘আপনারা বসুন। আমার একটা বিবৃতি দেওয়ার আছে!’’ শুক্রবার শহরের দুই প্রান্তে, দুই মঞ্চে বিরাট কোহলি সরবে একটা কথা বুঝিয়ে গেলেন— অনুষ্কার পাশে তিনি আছেন, থাকবেন।

সকালে টিম হোটেলে একপ্রস্ত বিস্ফোরণের পর মনে করা হচ্ছিল, আজকের মতো শেষ। সেটা যে কত বড় ভুল, ইডেনে কেকেআর-আরসিবি প্রাক্-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করার আধ সেকেন্ডের মধ্যে বুঝিয়ে দিলেন বিরাট। ‘‘আপনারা প্লিজ নোট নিন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের পর যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা নিয়ে আমি বলতে চাই। যে ভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লোকে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিল, বিশেষ করে অনুষ্কাকে যে ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছিল, খুব অসম্মানজনক’’— কথাগুলো যখন বলছিলেন ভারতের নতুন টেস্ট অধিনায়ক, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বসে সাংবাদিককুল। স্বর কাঁপছে, থামছে, আবার শুরু করছেন। বিরাট বলছেন, ‘‘খুব আঘাত পেয়েছি আমি। লোকের

বোঝা উচিত, আমরাও তো মানুষ। কথাগুলো বলছি যাতে লোকে বোঝে, এই ধরনের আলোচনা আমাদের মনে কতটা প্রভাব ফেলে। ভাবাই যায় না, লোকে অনুষ্কাকে দায়ী করছে আমার ব্যর্থতার জন্য। দেশের ব্যর্থতার জন্য। অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি।’’

শুনলে মনে হবে, ক্রিকেটার কোথায়, ইনি তো এক ‘প্রতিবাদী’ যুবক, যিনি প্রেমিকার অপমানে রোজ পুড়ছেন!

পুড়বেন নয় তো কী? বিরাট-অনুষ্কাকে নিয়ে যা ঘটেছে, তার সমতুল্য কোনও উদাহরণ কার্যত পাওয়া যাবে না যদি ক্রিকেটের বাইরের ক্রীড়াবিশ্বকে ধরা হয়। ব্রাজিল বিশ্বকাপে স্ত্রী-বান্ধবীদের উপস্থিতি নিয়ে কাউকে কথা শুনতে হয়নি। ফাইনালে হারের পর মেসিকে শুনতে হয়নি। গ্রুপ লিগ থেকে ছিটকে গিয়ে রোনাল্ডোকে শুনতে হয়নি। এমনকী জার্মানির কাছে সাত গোল খাওয়া স্কোলারির ব্রাজিলকেও শুনতে হয়নি— ‘স্ত্রী-বান্ধবীদের নিয়ে ছিলে বলে ডুবেছ।’ ফেডেরার-মারে-জকোভিচরা যখন গ্র্যান্ড স্লাম খেলতে যান, প্লেয়ার্স বক্সে তাঁদের স্ত্রী-বান্ধবীরা বসে থাকেন। কেউ কোনও প্রশ্ন তোলে না।

কিন্তু বিরাটের বেলায় তোলে। কাপ সেমিফাইনাল দেখতে যাওয়া অনুষ্কার সামনে বিরাট তাড়াতাড়ি আউট হয়ে গেলে লেখা হয়— ‘মাঠে তুমি ছিলে বলে বিরাট পারল না। তুমি ছিলে বলে দেশ হারল!’ এই আক্রমণের লক্ষ্য কে? এমন এক অভিনেত্রী, খ্যাতির জন্য যাঁর ‘বিরাট কোহলির প্রেমিকা’ স্টিকারের আদৌ দরকার নেই। তিনি শাহরুখ-আমিরের সঙ্গে দাপিয়ে অভিনয়টা করেন। অথচ মার্চের শেষ সপ্তাহে তাঁকে নিয়েই হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছিল চুটকি— ‘বিশ্বের সেরা প্রেমকাহিনি কোনটা? বিরাট-অনুষ্কা! সেমিফাইনালে প্রেমিকের ১ রান দেখতে প্রেমিকা সুদূর সিডনি পাড়ি দিলেন যে!’

এর পর আর উত্তর দেওয়ার জায়গা থাকে না যখন বিরাট বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছর ধরে আমি কিন্তু দেশের সেরা পারফর্মার। মনে হয় না, আমার মতো গত পাঁচ বছরে কেউ এত ধারাবাহিক ভাবে পারফর্ম করেছে। তার পরেও একটা ম্যাচে না পারলে আমাকে এ সব শুনতে হয়। এর পরেও লোকের ওপরে বিশ্বাস থাকে?’’ হৃৎপিণ্ড মুচড়ে যেন বার করে আনা কথাগুলো— ‘‘যারা এ সব বলেছে, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। আমি চিনে গিয়েছে কে আমার বন্ধু, কে আমার শত্রু। সব আমার জানা হয়ে গিয়েছে!’’

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে পুরো ঘটনার বিবরণ শুনিয়ে জিজ্ঞেস করা হল, তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? কাপ-সেমিফাইনালে অনুষ্কাকে নিয়ে দেশের একটা অংশে যখন তুমুল চর্চা চলছে তখন সৌরভই বলেছিলেন, এ ভাবে অনুষ্কাকে আক্রমণ করার কোনও অর্থই হয় না। প্রাক্তন অধিনায়ক সব শুনে নতুন করে আর ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকলেন না। বললেন, ‘‘এটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমার কথা বলাটা ঠিক হবে না।’’

বিরাট নিজে অবশ্য কোনও কিছুর তোয়াক্কা এ দিন করেননি। সকালে স্পনসরদের অনুষ্ঠানে প্রশ্নটা যেতেই সঞ্চালক থামাতে গিয়েছিলেন, ‘‘প্লিজ, এই প্রশ্নটা নয়।’’ বিরাট উল্টে তাঁকেই থামিয়ে দেন! বলেন, ‘‘আমি দেব উত্তর।’’ এক সাংবাদিক কী কুক্ষণে আবার প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক অফ ফর্ম নিয়ে। কপালে জুটল বক্রোক্তি, ‘‘আপনারাই ভাল বলতে পারবেন কখন আমার ফর্ম পড়ে, আর কখন ফর্মে থাকি। আমি নিজে তো বুঝতে পারি না। আমি দু’টো ম্যাচে রান না পেলে বলা হয়, ‘ব্যর্থ। অফ ফর্ম।’ কিন্তু অন্য ক্রিকেটার যদি দশটা ম্যাচের মধ্যে দু’টোয় রান করে, তখন সে ফর্মে থাকে!’’

আসলে বিরাট বোধ হয় এত দিনে জেনে গিয়েছেন, কেউ তাঁর তাঁর জীবন-দর্শন বুঝবে না। বুঝবে না, শুধু বাইশ গজের সাফল্যটাই তাঁর জীবনের চরম প্রাপ্তি নয়। বুঝবে না, ক্রিকেট ব্যাটের বাইরেও তাঁর একটা পৃথিবী আছে। আর তাই এখন থেকে ‘লাভ গেম’ খেয়ে গেলে কোনও না কোনও সময়ে প্রতিপক্ষকে ‘স্ট্রেট সেটে’ উড়িয়ে দিতেই হবে।

আর তাই বোধ হয় বিরাট কোহলিকে এখন থেকে আর থামানোই যাবে না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement