মহড়া: সোমবার অনুশীলনে ফ্রান্সের তিন সেরা তারকা। (বাঁ দিক থেকে) বেঞ্জেমা, এমবাপে ও পোগবা। ছবি রয়টার্স।
এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।
কোভিড-১৯ অতিমারির সংক্রমণ তখন ভয়ঙ্কর। সব কিছু থমকে দাঁড়িয়েছিল। ফরাসি ফুটবল লিগ তখন বিপর্যস্ত। আমাদের দেশের সরকার লিগটা বন্ধই করে দিয়েছিল। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিল ফরাসি ফুটবল। এই ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে ফরাসি ফুটবল লিগ একটি সংস্থার সঙ্গে নতুন চুক্তি করে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে সেই সংস্থাও সরে দাঁড়ায়। জোড়া আর্থিক ধাক্কায় তখন আমাদের লিগের টালমাটাল অবস্থা।
সেই পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা শুরু হয়। আমাদের সরকার ঋণ দিয়েছে ফুটবল কাঠামো ঠিক করার জন্য। পেশাদারি ফুটবল আস্তে আস্তে ফিরছে। কিন্তু অপেশাদারি ফুটবল এখনও বন্ধ। প্যারিসের রাস্তায় আগে হাঁটলে চোখে পড়ত নানা জায়গায় বাচ্চারা খেলছে। সেই দৃশ্য এখনও ফেরেনি। এই অবস্থায় কালো অন্ধকারে একটা আলোর রেখা হয়ে দেখা দিচ্ছে ইউরো কাপ।
ইউরোর দামামা এখানে বেজে গিয়েছে ভাল রকম। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমে ইউরো নিয়ে তুমুল হইচই হচ্ছে। হইচইটা শুরু হয়েছে ফ্রান্সের দল ঘোষণার সময় থেকে। আর প্রচারমাধ্যমের আলোটা সব চেয়ে বেশি পড়েছিল বিশেষ এক ফুটবলারের উপরে। করিম বেঞ্জেমা। বিতর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে ও জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিল। প্রায় ছ’বছর বাদে জাতীয় দলে ফিরে এল। বেঞ্জেমার এই প্রত্যাবর্তন কিন্তু ফরাসি ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে। সপ্তাহ খানেক ধরে এখানকার সংবাদপত্রের খেলার পাতায় বেঞ্জেমাই সব চেয়ে বড় খবর।
আজ, মঙ্গলবার রাতে ইউরোর গ্রুপ পর্বের সব চেয়ে বড় ম্যাচটা হতে চলেছে। ফ্রান্স বনাম জার্মানি। গত কয়েক মাস ধরে প্যারিসের অবস্থা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখানকার পানশালাগুলো খুলতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত পানশালার ভিতরে প্রবেশ করা যেত না। বারান্দায় বসতে হত। এই সপ্তাহ থেকে ভিতরে বসার অনুমতি মিলেছে। আমি নিশ্চিত, পানশালায় বসে খেলা দেখার জন্য ভিড় কম হবে না।
চাণক্য: জার্মানি দ্বৈরথের মহড়ায় ব্যস্ত ফ্রান্সের কোচ দেশঁ। ছবি রয়টার্স।
প্যারিসে সরকারি ভাবে একটা জায়ান্ট স্ক্রিন বসিয়ে খেলা দেখানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। খোলা মাঠের মতো জায়গায় চেয়ারে বসে খেলা দেখতে পারবেন দর্শকরা। তবে একটা অদ্ভুত নিয়মও চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি বসে খেলা দেখা যাবে, কিন্তু গোল দিলে বা গোল খেলে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠা যাবে না! কোনও রকম উৎসব করা যাবে না। ভাবতে পারেন, জার্মানির বিরুদ্ধে কিলিয়ান এমবাপে গোল করছে, আর ফরাসি ফুটবলপ্রেমীরা চুপচাপ চেয়ারে বসে হাততালি দিচ্ছে! আমি তো ভাবতেই পারছি না। তাই এই নিয়ম কতটা মানুষ মানবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের এই দলটাকে নিয়ে দেশের মানুষের স্বপ্ন অনেক। আর সেই স্বপ্নটা দেখাচ্ছেন ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ে দেশঁ। ফরাসি কোচের রণনীতি নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকলেও তাঁর হার-না-মানা মনোভাব নিয়ে কারও সংশয় নেই। দেশঁ একটা কথা বারবার বলেন— ‘‘আমাকে অসাধারণ একটা দল দিতে হবে না। আমাকে এমন কতগুলো ছেলে দাও, যাদের নিয়ে আমি একটা অসাধারণ দল তৈরি করতে পারি।’’ দেশঁর এই মনোভাব কিন্তু ফ্রান্সে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে এটাও বলব, সেই ১৯৯৮-২০০০ সালের দলটার পাশে এই দলকে এখনও বসায় না দেশের মানুষ। জ়িনেদিন জ়িদানদের সেই দলে শিল্প ছিল, জাদু ছিল। এই দলটা অনেকটা যান্ত্রিক। তা ছাড়া দেশঁর রক্ষণাত্মক ফুটবল নীতির ভক্তও সবাই নয়।
গত দশ বছর ধরে খুব কাছ থেকে ফরাসি ফুটবলকে দেখছি। যে কারণে বলব, অন্যান্য বারের তুলনায় এ বারের প্রস্তুতিটা সে ভাবে হয়নি। কোভিডের কারণে অনেক বিধিনিষেধ ছিল। দু’টোর বেশি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা যায়নি। আর শিবির চলাকালীন শেষ দিকে একটা বিতর্কও তৈরি হয়। ফরোয়ার্ড লাইনের দুই তারকা— অলিভিয়ের জিহু আর কিলিয়ান এমবাপের মধ্যে একটা ঝামেলা ঘিরে। যা নিয়ে ফরাসি সংবাদমাধ্যমে বেশ হইচই হচ্ছে। দিন কয়েক আগে একটা প্রস্তুতি ম্যাচে খেলার পরে জিহু ইঙ্গিত দিয়েছিল, এমবাপের সঙ্গে খেলতে ওর সমস্যা হচ্ছে। এমবাপে নাকি ঠিকমতো বল বাড়ায় না ওকে। এর পরে খবর ছড়িয়ে পড়ে, এমবাপে ব্যাপারটা একেবারেই ভাল ভাবে নেয়নি। দলের মধ্যে অশান্তির চোরাস্রোত তৈরি হয়েছে। গত কাল এমবাপেকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, ব্যাপারটা আদৌ সে রকম কিছু নয়।
একটু ভিতরের খবর জানার সূত্রে বলব, দেশঁ দলের মধ্যে কোনও বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করেন না। কঠিন শাসনের মধ্যে রাখেন দলকে। নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি, সব বিরোধ পিছনে ফেলে রেখেই ফ্রান্স আজ মাঠে নামবে।