উষ্ণতা: কলকাতায় এমনই ভালবাসা পেতেন গুরু মর্গ্যান। ফাইল চিত্র
রবিবার সকাল থেকেই মনটা একটু খারাপ। শতবর্ষের সূচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না।
আমার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা ইংল্যান্ডে। আমাদের পুরো পরিবার ওয়েস্ট হ্যামের সমর্থক। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। তা সত্ত্বেও লাল-হলুদ সমর্থকদের আবেগ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ওঁদের জন্যই কলকাতায় পা দেওয়ার পর থেকে ইস্টবেঙ্গল আমার হৃদয়ে।
২০১০ সালে প্রথম বার ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিই। আমার নাম কোচ হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন মোহনবাগানের প্রাক্তন কোচ স্টিভ ডার্বি। ইস্টবেঙ্গল কর্তারাও তখন নতুন কোচ খুঁজছিলেন। ডার্বির পরামর্শে ই-মেল করি ক্লাবে। ওরাও আমাকে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। পার্থ থেকে কলকাতায় পৌঁছে দেখলাম, বিমানবন্দরের বাইরে আমাকে স্বাগত জানতে কয়েকশো ইস্টবেঙ্গল সমর্থক লাল-হলুদ পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি অবশ্য অবাক হইনি। ডার্বির কাছেই শুনেছিলাম, লাল-হলুদ সমর্থকদের উন্মাদনার কথা।
প্রথম দিন ক্লাব তাঁবুতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এক জন পেশাদার কোচের কাছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ ও পরিকাঠামো। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে দু’টোই ছিল। মাঠ থেকে জিম— সব কিছুই দুর্দান্ত। অনুশীলনের জন্য যখন যা দরকার, প্রথম দিন থেকেই সব পেয়েছিলাম। মনে আছে, প্রথম দিন আমার অনুশীলন দেখতে গ্যালারি ভরে গিয়েছিল। তবে উন্মাদনা কাকে বলে তা দেখেছিলাম কলকাতায় আমার
প্রথম ডার্বিতে।
সল্টলেকের যে বাড়িতে ক্লাব আমাকে রেখেছিল, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে থেকে তা মিনিট দশেকের দূরত্বে। ডার্বির দিন দুপুরে দেখলাম, স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা পুরোপুরি দু’দলের সমর্থকদের দখলে। হাতে পতাকা, মুখে রং মেখে কেউ হাঁটছেন। কেউ কেউ যাচ্ছেন গাড়িতে, ম্যাটাডর ভ্যানে চড়ে। বিপক্ষ দলের সমর্থকদের দেখলেই শুরু যাচ্ছে হুঙ্কার, পাল্টা হুঙ্কার। ইংল্যান্ডেও দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের মধ্যে এ রকম রেষারেষি। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বনাম ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। আর্সেনাল বনাম চেলসি। আর্সেনাল বনাম টটেনহ্যাম হটস্পার। লিভারপুল বনাম এভার্টন। ম্যাচ থাকলেই পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, ডার্বির আগে পরিবারের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে ছেলের কথা বন্ধ হয়ে যায়। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে লড়াই। কী হয় না! কলকাতা ফুটবলেও এক ছবি। মনে হত যেন, ইংল্যান্ডেই রয়েছি। সেই একই রকম আবেগের বিস্ফোরণ। ফুটবল নিয়ে পাগলামি। এই পরিচিত পরিবেশটাই ডার্বির আগে আমাকে উদ্বেগহীন থাকতে সাহায্য করত।
ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে অসংখ্য ডার্বি জিতেছি। প্রত্যেকবারই নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। ডার্বি জয়ের পরে পায়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজস্বীর আবদার মেটানো তো ছিলই। আমার বাড়িতেও ফুল, নানা উপহার নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন ওঁরা। ম্যাচের পরের দিন সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠতাম। কিন্তু ডার্বি থাকলে তা হওয়ার উপায় ছিল না। সাতসকালেই হাজির হয়ে যেতেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা। ওঁদের এই ভালবাসা আমাকে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক করে তুলেছিল। যদিও পেশাদার কোচ হিসেবে আমার কোনও দলের প্রতি দুর্বলতা থাকা উচিত নয়। কিন্তু ইস্টবঙ্গল নামটা শুনলে এখনও অন্য রকম অনুভূতি হয়। ক্লাবের সঙ্গে বিচ্ছেদের অস্বস্তিকর অধ্যায়ও যা কাঁটা হয়ে উঠতে পারেনি কখনও।
লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে আরও একটা কারণে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ওঁরাই আমাকে ইলিশ মাছ খেতে শিখিয়েছেন। মনে পড়ে গেল, অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলে কলকাতায় ফিরেছি। দু’জন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য ইলিশ মাছ নিয়ে হাজির বিমানবন্দরে। আমার হাতে মাছটা দিয়েই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও ওঁদের খুঁজে পাইনি। দৃশ্যটা ভাবুন একবার— বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এক হাতে লাগেজ, অন্য হাতে আস্ত ইলিশ মাছ! সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমার তখন একটাই চিন্তা, কী করব মাছ নিয়ে? এর আগে কখনও ইলিশ মাছ খাইনি। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলেন আমার কুক। দুর্দান্ত রান্না করলেন। ভয়ে ভয়ে এক টুকরো মুখে দিতেই অভিভূত হয়ে গেলাম। অসাধারণ স্বাদ। তার পরে অনেক বার ইলিশ মাছ খেয়েছি।
ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের সূচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রপত্র যে দিন পেলাম, দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। যদি সম্ভব হত, আমন্ত্রণ না জানালেও কলকাতায় পৌঁছে যেতাম। আমি পেশাদার কোচ হলেও ইস্টবেঙ্গল সব সময়ই আমার হৃদয়ে থাকবে। তাই প্রিয় ক্লাবের শতবর্ষ সূচনা অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে না পারার আক্ষেপ থেকেই যাবে। ইন্টারনেটে পড়লাম, বিশ্বের সর্বত্র ইস্টবেঙ্গল দিবস পালন করা হবে। আশা করছি, পার্থেও অনেক লাল-হলুদ সমর্থক আছেন। তাঁরাও নিশ্চয়ই ইস্টবেঙ্গল দিবস পালন করবেন। আমাকে আমন্ত্রণ করার দরকার নেই, কোথায় হবে জানতে পারলে নিজেই চলে যাব। ভারতীয় ফুটবলে আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। এই ক্লাবের কাছে আমি চিরঋণী। প্রার্থনা করব, ইস্টবেঙ্গল যেন আরও সফল হয়। তবে আই লিগ দিতে না পারার যন্ত্রণা কখনও ভুলতে পারব না!