স্বপ্নভঙ্গ: ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে হারের পরে ভেঙে পড়েছেন ভারতীয় মহিলা হকি দলের মিডফিল্ডার নেহা গয়াল। শুক্রবার টোকিয়োয়। (খবর: খেলা)। রয়টার্স
মা পরের বাড়িতে কাজ করেন, বাবা ঠেলাগাড়ি টানেন, বাড়িতে বিজলি বাতি লোডশেডিংয়ের জ্বালায় জ্বলতেই চায় না, আর পনপন করে মশা উড়ে উড়ে কামড়ায়, আর দু’বেলা পেট পুরে খাবার জোটে না বড় একটা। এই কাহিনি ভারতবর্ষের সংখ্যাধিক মানুষেরই জীবনচিত্র। ভারতীয় মহিলা হকি দলের অধিনায়কেরও। রানি রামপালের পেখমের মতো ঝলমলে কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। না গ্ল্যামার, না বৈভব। নিজেদের তুচ্ছতা ভুলতেই মেয়েটি একদা সালোয়ার কামিজ পরেই একটা ভাঙা হকিস্টিক নিয়ে খেলতে নেমে পড়েছিল। আর মাত্র পনেরো বছর বয়সেই সে জাতীয় দলে খেলার ডাক পেয়ে যায়। দরিদ্র দলিত পরিবারের মেয়ে বন্দনা কটারিয়া। আর্জেন্টিনার কাছে সেমিফাইনালে ভারত হেরে যাওয়ায় উত্তরাখণ্ডে বন্দনার বাড়িতে উঁচু বর্ণের কিছু নিচু লোক হামলা করে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। ‘ছোটলোকের’ বাড়বাড়ন্ত তাদের বরদাস্ত হয়নি। তারা ভারতীয় দলের পরাজয়কে তাই সেলিব্রেট করেছিল।
নেহা গয়ালের মদ্যপ বাবা প্রতি দিন নেশা করে এসে নেহার মাকে হেনস্থা করতেন। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারত না বলেই সে হকির মাঠে পালিয়ে যেত, খেলায় ডুবিয়ে দিত নিজেকে। নিকি প্রধান ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার মেয়ে, যার হকিস্টিক কেনারও পয়সা ছিল না। দিনমজুর হিসেবে খেটে সে তার প্রথম হকিস্টিক কেনে। আর জুতো কিনতে পারে, রাঁচী অ্যাকাডেমিতে খেলার সুযোগ পাওয়ার পরে। নিশা ওয়ারসি হকি খেলতে শুরু করেছিল কেন? এক দর্জির মেয়ে নিশা ভেবেছিল, হকি খেলতে তো বেশি জিনিসপত্র লাগে না, শুধু একটা হকিস্টিক। তাই। তা সেই দর্জি বাবাও রোগে পঙ্গু হয়ে গেলেন, মা সংসার চালাতেন একটা ফোম ফ্যাক্টরিতে মজুর খেটে। মিজোরামের লালরেমসিয়ামি তো হিন্দি বা ইংরেজি কিছুই বলতে পারত না। কথা বলত ইশারা-ইঙ্গিতে।
না, ভারতীয় মহিলা হকি দল এ বার টোকিয়ো অলিম্পিক্সে কোনও পদক জিততে পারেনি। অল্পের জন্য সেমিফাইনালে তারা আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যায়। ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে ৪-৩ গোলে হারে ব্রিটেনের কাছে। কিন্তু আমার তো মনে হয়, এই সব সোনার টুকরো মেয়েরা আমাদের যে গৌরব এনে দিয়েছে, তা মাথা উঁচু করে গ্রহণ করার মতোই। এ দেশে ক্রীড়া পরিকাঠামো কত দুর্বল, তা ভুক্তভোগীরা জানেন। সম্পন্ন দেশের প্রতিযোগীদের পিছনে থাকেন দামি প্রশিক্ষক, ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট, ডায়েটিশিয়ান, সাপোর্ট স্টাফ, অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল সরঞ্জাম, এবং প্রয়োজনে সাইকায়াট্রিস্টও। বেশির ভাগ ভারতীয় প্রতিযোগীর ভাগ্যে কিন্তু এত বাবুগিরি জোটে না। অন্তত এত কাল জুটত না। এখন কিছু কিছু জোটে, তা-ও যথেষ্ট নয়।
আমি নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে আমাদের মেয়েদের ম্যাচটা দেখছিলাম। ওদের কী বড়সড় চেহারা আর শারীরিক বিক্রম! ভারতের রোগা মেয়েরা ওদের শরীরের ধাক্কাতেই বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল। তবু আকণ্ঠ চেষ্টা করছিল তারা। মনে হচ্ছিল, আমাদের মেয়েদের কুশলতার অভাব নেই, কিন্তু মৌলিক স্বাস্থ্যও দরকার। যে প্রেক্ষাপট থেকে এরা উঠে এসেছে, তাতে স্বাস্থ্য-সমৃদ্ধ হওয়ার কথা নয়। তাই এই হার। কিন্তু ভুল। আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ভারতের মেয়েরা বড়সড় চেহারার অস্ট্রেলিয়ানদেরও তো হারাল! কী করে? এবং আর্জেন্টিনা আর ব্রিটেনকেও কম ঘোল খাওয়ায়নি! ভবিষ্যতে এরা যে কোনও দলকেই যে হারিয়ে দিতে পারবে, তার সঙ্কেত টোকিয়োয় দিয়ে রাখল তারা।
ভারতের মহিলা হকি দল এ যাবৎ তেমন কোনও কৃতিত্বের পরিচয় দেয়নি। রিয়ো অলিম্পিক্সে তাদের তেমন সাফল্য নেই। কিন্তু টোকিয়োয় আমরা যে উজ্জীবিত দলটিকে দেখলাম, তা আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে। মাঠঘাট থেকে উঠে আসা, খিদে ও অভাবের সঙ্গে লড়াই করা, অবিরত নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাঞ্ছনা এবং অপমানের শিকার হওয়া, পরিবারের আনুকূল্য না পাওয়া এই সব মেয়েরা যে অলিম্পিক্সে এত দূর যাবে, কেউ তা স্বপ্নেও ভেবেছিল? ভাগ্য আর একটু সহায় হলে তারা অন্তত ব্রোঞ্জটা আনতে পারত। তবু অলিম্পিক্স থেকে তারা যা নিয়ে আসছে, তা-ও কম কিছু নয়। গোটা দুনিয়া সবিস্ময়ে জেনেছে, কোন প্রেক্ষাপট এবং কোন পরিকাঠামো থেকে উঠে এসে এরা দুনিয়াকে চমকে দিয়ে গেল! ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।