জাদুকর: আশির দশকে তখন ময়দান মাতাচ্ছেন মজিদ বাসকার। ফাইল চিত্র
আশির দশকের শুরুতেই বিপর্যয় নেমে এল ইস্টবেঙ্গল শিবিরে। সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়-সহ একঝাঁক ফুটবলার চলে গিয়েছিল মহমেডানে। আমাদের দলটাকেই ওরা ভেঙে দিয়েছিল। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য অবশ্য ক্লাব ছাড়েনি।
দল গড়ব কী করে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল আমাদের। সুধীর কর্মকার, মহম্মদ হাবিবকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। সেই সময় মহমেডানেরই এক জন আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তাঁর নাম, মহম্মদ মাসুদ। মহমেডানের প্রাক্তন ফুটবল সচিব। ইরফান তাহের সেই সময় মহমেডানের সচিব হওয়ায় ও ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে আসে। মাসুদ আমার খুব ভাল বন্ধুও। এক দিন বলল, ‘‘তোমরা ফুটবলার খুঁজছো? আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানের তিন ফুটবলার পড়ছে। মজিদ বাসকার, জামশিদ নাসিরি ও খাবাজি। এর মধ্যে মজিদ ইরানের বিশ্বকাপ দলেও ছিল। আমি ওদের খেলা দেখেছি। মজিদ দুর্ধর্ষ ফুটবলার। জামশিদেরও হেড খুব ভাল। খাবাজি খেলে মাঝমাঠে।’’ মাসুদের এক বন্ধু সাব্বিরও জানাল যে, তিন জনই খুব ভাল ফুটবলার।
ইস্টবেঙ্গলের সহ-সচিব তখন ছিলেন অরুণ ভট্টাচার্য। তাঁর কাছেও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ফুটবলারের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। ক্লাবের সচিব সেই সময় ছিলেন নিশীথ ঘোষ। আমি ও অরুণ ভট্টাচার্য দু’জনেই সচিবকে মজিদদের কথা জানাই। সঙ্গে সঙ্গেই মজিদ, জামশিদ ও খাবাজিকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, মাসুদ মহমেডানের প্রাক্তন ফুটবল সচিব ছিল। ফুটবলারদের খুব ভাল চিনত। তাই ওর কথা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলাম। নিশীথদা তিন ফুটবলারকে দেওয়ার জন্য অগ্রিম হিসেবে আমাকে আশি হাজার টাকা দেন। আমি সেই টাকা পৌঁছে দিয়েছিলাম মাসুদের কাছে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে পুরো ব্যাপারটা সামলেছিল মাসুদ-ই। সঙ্গে ছিলেন অরুণদা ও সাব্বির।
মজিদ কত বড় ফুটবলার ছিল আমরা সেই সময় সত্যিই জানতাম না। মাসুদের কথা শুনে ওদের নিয়ে এসেছিলাম। সত্তর ও আশির দশকে দলবদলের অনেক রোমহর্ষক কাহিনি রয়েছে। মজিদকে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার কিছুই হয়নি। প্রায় নিঃশব্দেই সই করানো হয়েছিল। আসলে মজিদ কেমন ফুটবলার, তার কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। ভারতীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠ বিদেশি কেন বলা হয় মজিদকে, তা কয়েক দিন মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। মজিদের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে দার্জিলিং গোল্ড কাপের সেই ম্যাচটার কথা। ০-২ হারছিলাম আমরা। শেষ ৬০ মিনিটে তিন গোল করেছিল ও। রোভার্স কাপে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ০-২ পিছিয়ে ছিলাম। মজিদের জন্য ২-২ হল। পরের দিন আবার হারছিলাম। কিন্তু হরজিন্দরের জোড়া গোলে ২-১ জিতেছিলাম। ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল মহমেডান। ফের এক ছবি। গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। সেই অবস্থায় মজিদের সেই অবিশ্বাস্য গোল। যে গোলটার প্রসঙ্গ উঠলে এখনও ভাস্কর বলে, ‘‘৩৫ গজ দূর থেকে মজিদ শট নিয়েছিল। আমি বলের কাছেই পৌঁছতে পারিনি।’’
মজিদকে সহজে আমরা নিতে পেরেছিলাম আরও একটা কারণে। ইমরান তাহের সে-বছর প্রচুর টাকা খরচ করেছিল দল গড়তে। ফলে ওদের মজিদ, জামশিদ ও খাবাজিকে নেওয়ার অবস্থা ছিল। মজিদকে হয়তো নিতে পারত। কিন্তু ও আবার জামশিদ ও খাবাজিকে ছাড়া খেলবে না। ফলে মহমেডান খুব একটা উৎসাহ দেখায়নি ওদের নেওয়ার ব্যাপারে। সব চেয়ে বড় কথা, ওরাও আন্দাজ করতে পারেনি মজিদ কত বড় মাপের ফুটবলার।
আমরা অগ্রিম দেওয়ার পরেই খাবাজি কলকাতায় এসেছিল। সব কিছু চূড়ান্ত করে আলিগড় ফিরে যায়। প্রদীপ কুমার বন্দ্যাপাধ্যায় অনুশীলন শুরু করার পরে তিন জন চলে আসে কলকাতায়। বিমানবন্দরে ওদের আনতে আমিও গিয়েছিলাম। প্রথমে ওরা উঠেছিল আমাদের সচিব নিশীথ ঘোষের হোটেলে। পরে থিয়েটার রোডের কাছে একটা বাড়িতে ওদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় মজিদ ও জামশিদ কথা প্রায় বলতই না। যা কিছু বলার খাবাজিই বলত। ধীরে ধীরে ইস্টবেঙ্গলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরে কথা বলত মজিদ। যদিও কোনও দিনই বেশি কথা বলত না। মাংস খেতে খুব ভালবাসত।
মজিদকে নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। মোহনবাগানের কোচ তখন অরুণ ঘোষ। রক্ষণে প্রদীপ চৌধুরী। হাফটাইমে কোচকে উনি বলছেন, ‘‘কী করে আটকাবো মজিদকে। ডান-বাঁ, সামনে-পিছনে সব জায়গায় তো মজিদ। এই ধরনের ফুটবলারকে কি ধরা যায়?’’ এই ছিল মজিদ। অসাধারণ ড্রিবল করতে পারত। বাঁ-পায়ে দুর্দান্ত শট ছিল। মজিদকে যত দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। এত বড় মাপের ফুটবলার আগে কখনও দেখিনি। অবিশ্বাস্য। আক্ষরিক অর্থেই ফুটবলের ‘বাদশা’ ছিল। দুর্ভাগ্য ওর খেলা আমরা বেশি দিন দেখতে পেলাম না। মানসিক অবসাদ ও বিভিন্ন কারণে আস্তে আস্তে খেলা থেকে হারিয়ে যেতে থাকল। অনেক চেষ্টা করেও মজিদের অবসাদ আমরা দূর করতে পারিনি। ওর প্রিয় বন্ধু জামশিদও ব্যর্থ হয়েছিল।
আমার মনে হয় মজিদের অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ওর অসাধারণ প্রতিভা। ওর যা দক্ষতা ছিল, তাতে অনেক বড় জায়গায় খেলার কথা ছিল। অথচ খেলছে ভারতের একটি ক্লাবে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরানে ওর পরিবার থাকত। আত্মীয়-স্বজন কেমন আছে তার কোনও খবর দিনের পর দিন পেত না। যা ওকে মানিসক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। এই কারণেই প্রথম বছরের পরে সে-ভাবে ওকে আর পাইনি। অকালেই ঝড়ে গিয়েছিল মজিদের মতো প্রতিভা।