badminton

Badminton: বচ্চন-মোদীরাও স্যালুট করে যাচ্ছেন! ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের বদলে যাওয়া ছবি

আগে বড় প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করলে, কেউ ক্রমতালিকায় প্রথম ১০০-এ ঢুকলে ব্যাডমিন্টনে শিরোনাম হত। এখন সারা বছর নিয়ম করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভারতীয়রা অনায়াসে যোগ্যতা অর্জন করছেন। এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ফাইনালে ভারতীয়দের না ওঠাটাই খবর। কী ভাবে সম্ভব হল এই বদল?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২২ ১৭:৩৭
Share:

টমাস কাপের মতো দলগত ব্যাডমিন্টনে ভারতের এই সাফল্যের অন্য তাৎপর্য আছে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ

পিভি সিন্ধু, সাইনা নেওহালদের হাত ধরে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন জনপ্রিয় হয়েছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। অলিম্পিক্সেও এ দেশে ব্যাডমিন্টনে পদক এসেছে, এটা পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে সত্যি। কিন্তু টমাস কাপের মতো দলগত ব্যাডমিন্টনে ভারতের এই সাফল্যের অন্য তাৎপর্য আছে। ব্যক্তিগত স্তরে সাফল্য আর দলগত ব্যাডমিন্টনের সাফল্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। টমাস কাপের সাফল্য বুঝিয়ে দিচ্ছে এখন ভারতীয় ব্যডমিন্টনের গভীরতা কতটা।

এই গভীরতা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। ২০-২৫ বছর আগেও ছবিটা ভিন্ন ছিল। নয়ের দশকে পুল্লেলা গোপীচন্দের মা সংবাদপত্রের দফতরে দফতরে ফোন করে তাঁর ছেলের খেলার ফল জানাতেন। মোবাইলহীন যুগে তখন ভিন রাজ্যে ফোন করতে এসটিডি করতে হত। তার খরচও ছিল বিস্তর। ফলে গোপীর মা-কে ল্যান্ড লাইনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে গিয়েও দু’বার ভাবতে হত— এই ফোন বি‌ফলে যাবে না তো? চাইতেন, পিছনের পাতায় সিঙ্গল কলামের শেষ খবরটিতেও যদি অন্তত ছেলের খেলার ফলটুকু ছাপা হয়।

Advertisement

সেই গোপী ২০০১ সালে অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জেতার পরেও উপরের ছবিটার খুব বদল হয়নি। পরিবর্তন শুরু হয় গোপী প্রশিক্ষণে আসার পর থেকে। তত দিনে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা হয়ে গিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার জোরে গোপীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনকে ‘আধুনিক’ করতে গেলে কী কী দরকার। ২০০৪ সালে তৈরি করেন পুল্লেলা গোপীচন্দ ব্যাডমিন্টন আকাদেমি (পিজিবিএ)।

২০০৪ সালে তৈরি করেন পুল্লেলা গোপীচন্দ ব্যাডমিন্টন আকাদেমি। —ফাইল চিত্র

বিভিন্ন শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্রিকেট-ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলির মতো নয়, একটা আস্ত আকাদেমি গড়ে তুলতে যা যা প্রয়োজন, তার সবই ধাপে ধাপে পিজিবিএ-তে যোগ করেন গোপীচন্দ। এখন ১৭টি ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ১০০টি থাকার ঘর, জিমন্যাসিয়াম, স্যুইিং পুল, আইস বাথ-স্টিম বাথ নেওয়ার ঘর, দৌড়নোর ট্র্যাক, যোগ-এয়ারোবিক্স স্টুডিয়ো সবই রয়েছে। এর সঙ্গে গোপীর সংসারে রয়েছেন তিন জন সিনিয়র কোচ, তিন জন কোচ, দু’জন সহকারী কোচ, এক জন ফিটনেস ট্রেনার, সাইয়ের এক জন কোচ, পাঁচ জন ফিজিয়োথেরাপিস্ট, তিন জন ফিটনেস ট্রেনার, এক জন ম্যাসিয়োর। সবার উপরে গোপী তো আছেনই।

Advertisement

তিনি অবশ্য বুঝতে পারেন, শুধু বিশ্বমানের অ্যাকাডেমি তৈরি করলেই হবে না, আসল হল ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তা বাড়ানো। কী ভাবে তা সম্ভব হবে, সেটিও ভেবে ফেলেন তিনি। মাথায় ঢুকিয়ে নেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে না পারলে খেলার জনপ্রিয়তা বাড়বে না। ঠিক এই সময়ে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সুবিধে করে দেন সানিয়া মির্জা। ২০০৪ সালে তিনি গোপীচন্দের শহরেই জিতে নেন হায়দরাবাদ ওপেন টেনিস। কানায় কানায় ভর্তি টেনিস স্টেডিয়াম দেখে ব্যাডমিন্টনের গোপী নিজের মতো করে রসদ খুঁজে নেন। টেনিস পারলে ব্যাডমিন্টন পারবে না কেন?

তার পর থেকে প্রতি বছর হায়দরাবাদে একটি করে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হয়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাডমিন্টনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে। পুরোটাই হয়েছে গোপীর উদ্যোগে। পাশে পেয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্য সচিব এলভি সুভ্রমণিয়মকে।

অলিম্পিক্সে সাইনা দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দেন। —ফাইল চিত্র

টেনিসে সানিয়ার উত্থান ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তা কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরের ধাপে ব্যাডমিন্টন উন্নীত হয় সাইনার হাত ধরে। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সে সাইনা কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেন। ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ সাইনাকে নিয়ে চর্চা শুরু করেন। তাঁর প্রতিটি খেলা নজর কাড়তে শুরু করে। কোর্টের বাইরেও শুরু হয় সাইনাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী বলছেন, কী পরছেন, কোন বিজ্ঞাপনে তাঁকে দেখা যাচ্ছে— শুরু হয় সাইনাকে নিয়ে আলোচনা। ঠিক এটাই চেয়েছিলেন গোপীচন্দ।

সাইনাও হতাশ করেননি। দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসের ফাইনালে ওঠেন। স্টেডিয়ামে একটা আসনও ফাঁকা ছিল না সে দিন। এমনকী, বাইরের ‘হতাশ’ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। তার বছর খানের আগে পর্যন্ত এই ছবি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে অকল্পনীয় ছিল। একটার পর একটা প্রতিযোগিতা জিততে থাকেন সাইনা। যখন যেখানে খেলতে গিয়েছেন, সেখানকার প্রবাসী ভারতীয়রা তাঁর খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে হামলে পড়েছেন।

সাইনা সব থেকে জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন ইন্দোনেশিয়ায়। শোনা যায়, সেখানকার ট্যাক্সি চালকরাও সাইনার দেশের লোক শুনলে ভাড়া নেন না। বিদেশে এই জনপ্রিয়তা তার আগে পর্যন্ত শুধু সচিন তেন্ডুলকর, সুনীল গাওস্কর, কপিল দেবদের জন্য বরাদ্দ ছিল।

একাধিক অলিম্পিক্স পদকজয়ী সিন্ধু। —ফাইল চিত্র

২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে সাইনা দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দেন। কিন্তু সে বার ভারত অন্য খেলাতেও এতগুলি অলিম্পিক্স পদক পায়, সাইনার ব্রোঞ্জ কিছুটা হলেও চাপা প়ড়ে যায়।

তবে গোপীকে ভাবতে হয়নি। কারণ, তত দিনে তাঁর আকাদেমি জন্ম দিয়ে ফেলেছে আর এক জনের— তিনি পুসারলা ভেঙ্কট সিন্ধু। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে একের পর এক পদক জিততে শুরু করেন সিন্ধু। ২০১৬ সালে রিয়ো অলিম্পিক্সে তাঁর রুপো ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তায় বিস্ফোরণ ঘটায়। সিন্ধুর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে শুরু করে দু’টি কারণে। এক, তিনি সে বার অলিম্পিক্সের শেষ দিকে পদক জেতেন। দুই, তখনও রিয়ো অলিম্পিক্সে আর কোনও ভারতীয় পদক জেতেননি।

ক্যারোলিনা মারিনের বিরুদ্ধে তাঁর ফাইনাল ম্যাচের স্বাদ গোটা দেশ চেটেপুটে নিয়েছিল। রুপো জিতে যখন দিল্লিতে নেমেছিলেন, তখন বিমানবন্দর, হোটেলের উন্মাদনা যে জায়গায় পৌঁছেছিল, তার সঙ্গে ১৯৮৩ সালে কপিলদের বিশ্বজয় করে ফেরার দৃশ্যই তুলনীয়। হায়দরাবাদে সিন্ধুর ২০ কিলোমিটারের বিজয় প্যারেড টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। সন্তর্পণে একটা প্রশ্নও উঠেছিল, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের তাজ কি সাইনার কাছ থেকে সিন্ধুর কাছে চলে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পড়েছেন দু’জনেই। আর হেসেছেন শুধু গোপী। তিনি এটাই চেয়েছিলেন। সচিন-দ্রাবিড় ভুলে ভারতীয় জনতা এ বার যেন সাইনা-সিন্ধু করে। এখনও এই প্রশ্নের উত্তর পায়নি এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। গোপী চাইছেন, এই উত্তর যেন কোনও দিন না পাওয়া যায়। লড়াইটা থাকুক। চর্চা থাকুক। কাটা-ছেঁড়া থাকুক।

টমাস কাপ জয়ের অন্যতম নায়ক। —ফাইল চিত্র

টমাস কাপ জয়ে ভারতের অন্যতম নায়ক কিদম্বি শ্রীকান্ত ভারতীয় ব্যাডমিন্টনকে আর একটু এগিয়ে নিয়ে যান। চারটি সুপার সিরিজ খেতাব জেতেন, যে কৃতিত্ব অন্য কোনও ভারতীয়ের নেই। সাইনার সঙ্গে তিনিও বিশ্ব ক্রমতালিকায় এক নম্বরে চলে আসেন। যদিও দু’জনে মাত্র এক সপ্তাহ শীর্ষ স্থানে ছিলেন, তবু সেটা নিয়েও কম মাতামাতি হয়নি। সাইনা, সিন্ধুদের বিজ্ঞাপনের দরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।

সারা দেশে হাজার হাজার আকাদেমি গড়ে উঠতে শুরু করে। তত দিনে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন সাইনা আর সিন্ধুর সম্পত্তি হয়ে গিয়েছে। সেখানে ভাগ বসানোর জন্য আবির্ভাব হয় লক্ষ্য সেনের। তিনি অবশ্য গোপীচন্দের ছাত্র নন। তাঁর বেড়ে ওঠা বেঙ্গালুরুতে প্রকাশ পাড়ুকোনের আকাদেমিতে।

টমাস কাপ জিতলেন লক্ষ্য সেন। —ফাইল চিত্র

২০০৬ সালের আগে পর্যন্ত কেউ বড় প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করলে, কেউ ক্রমতালিকায় প্রথম ১০০-এ ঢুকলে ব্যাডমিন্টনে শিরোনাম হত। এখন সারা বছর নিয়ম করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভারতীয়রা অনায়াসে যোগ্যতা অর্জন করছেন। এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ফাইনালে ভারতীয়দের না ওঠাটাই খবর। সুইৎজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বার্মিংহাম, ইন্দোনেশিয়ায় সাইনা-সিন্ধুদের আলাদা ফ্যান বেস তৈরি হয়ে গিয়েছে।

আগে যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট দল আফগানিস্তানকে হারালেও নেটমাধ্যম উপচে পড়ত, এখন প্রণয়, সিন্ধুদের সাফল্যও অনায়াসে টুইটার, ফেসবুকে টেনে আনে অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্ত, নরেন্দ্র মোদীদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement