গোলাপি বলে টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুললেন প্রসন্ন। ফাইল চিত্র।
গোলাপি বলে দিনরাতের টেস্ট পাঁচ দিনের ফরম্যাটের ভবিষ্যৎ হতে পারে, স্পিনারদের নয়! এমনই মনে করছেন কিংবদন্তি অফস্পিনার এরাপল্লি প্রসন্ন।
তাঁর বরং আশঙ্কা, এই ধরনের টেস্ট গুরুত্বহীন করে তুলবে স্পিনারদের। আর এই ভাবে হারিয়ে যেতে পারে স্পিন নামের শিল্প, যা ক্রিকেটের ঐতিহ্যের পক্ষেই খুব একটা সুখকর হবে না। তাই গোলাপি বলের টেস্ট অশনি সঙ্কেত জারি করছে তাঁর কাছে।
রবিবার সকালে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বেঙ্গালুরুর বাড়ি থেকে প্রসন্ন বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না গোলাপি বলের টেস্টে একজন স্পিনারের ভূমিকা কেমন হতে চলেছে। একজন স্পিনার কতটাই বা গুরুত্ব পেতে চলেছে এই ঘরানায়, সেটাও চিন্তা করার মতো। এখন যা দেখছি, টি-টোয়েন্টি বা একদিনের ক্রিকেটেরই পরিবর্ধিত রূপ হয়ে উঠছে গোলাপি বলের টেস্ট। অন্তত স্পিনারদের জন্য তো একদম সেটাই দেখাচ্ছে। কারণ, শিশিরের জন্য ভুগতে হচ্ছে স্পিনারদের। বল ঘুরছে না, গ্রিপ করতেও সমস্যা হচ্ছে। ফলে স্টক বোলারদের মতো বল করতে হচ্ছে। যা ছোট ফরম্যাটে করতে হয় স্পিনারদের। রান আটকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের, উইকেট নেওয়ার জন্য নয়। এটা দুশ্চিন্তার। বিতর্কিতও। সে জন্য আমার মনে হচ্ছে গোলাপি বলের টেস্টের নেগেটিভ দিক রয়েছে। স্পিনারদের এ ভাবে মূল্য একেবারে কমিয়ে দেওয়া মানতে পারছি না। গোলাপি বলের টেস্ট আমার কাছে তাই বিতর্কিত।”
আরও পড়ুন: ফিরলেন এবাদত, কত ক্ষণ লড়াই চালাবে বাংলাদেশ? ইডেনে চোখ ক্রিকেটমহলের
ইডেনে শুক্রবার বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ভারতীয় স্পিনাররা মাত্র এক ওভার হাত ঘুরিয়েছিলেন। রবীন্দ্র জাডেজা তবু ছয় বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন, রবিচন্দ্রন অশ্বিন সেটাও পাননি। মোমিনুল হকদের প্রথম ইনিংসে অফস্পিনার ছিলেন শুধুই ফিল্ডার। শনিবার বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি অবশ্য পাঁচ ওভার বোলিং করেছেন। কিন্তু গোলাপি বলে টেস্টের দ্বিতীয় দিন জাডেজার হাতে বলই তুলে দেননি ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। প্রসন্ন সেটার দিকেই আঙুল তুলছেন। বোঝাতে চাইছেন যে, ঘরের মাঠেও ভারতীয় স্পিনাররা ব্যবহৃত হচ্ছে না। তার দরকারই পড়ছে না। যেহেতু বিদেশে এমনিতেও স্পিনারদের ভূমিকা সীমিত থাকে, তাই দেশেও যদি তাঁদের প্রয়োজন না পড়ে, তবে স্পিনাররা হারিয়েই যাবেন। স্পিন নামের শিল্পেরও হাল হবে করুণ।
এমনিতে গোলাপি বলে টেস্টের পটভূমি নিয়ে আপত্তি নেই প্রসন্নর। কিন্তু তার ফলাফল নিয়েই উদ্বিগ্ন তিনি। প্রাক্তন ক্রিকেটারের প্রশ্ন, “পিঙ্ক বলে ডে-নাইট টেস্টের আইডিয়া এসেছে মাঠে দর্শকদের টেনে আনার জন্য। এটাই প্রধান উদ্দেশ্য। রাতে গোলাপি বলেই একমাত্র টেস্ট হওয়া সম্ভব, তাই গোলাপি বলের টেস্ট। এটা গেল দর্শকদের মাঠে আনার ব্যাপার। তবে তার জন্য স্পিন-শিল্পকে বিসর্জন দেওয়া কি উচিত হবে, এটাই আমার জিজ্ঞাসা। স্পিন বলের কারিকুরি দেখতে তো ক্রিকেটপ্রেমীরাও ভালবাসেন। তাঁরা এর থেকে বঞ্চিত হবেন। সেটাও তো বড় ক্ষতি, তাই না?”
কিন্তু বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম যে ভারতীয় ইনিংসে ২৫ ওভার বল করলেন। ৮০ রান দিয়ে নিলেন অজিঙ্ক রাহানের উইকেট। তা হলে স্পিনারদের ভূমিকা থাকছেই না, বলা যায় কি? প্রসন্নর পাল্টা সওয়াল, “আরে, বাংলাদেশের তো আর কিছু করার ছিল না। ওদের পেসাররা একদম সাদামাটা। একমাত্র স্পিনারকে তো বল দিতেই হয়। বাকিরা এত খারাপ যে ওকেই মনে হচ্ছে ভাল। কিন্তু আমাদের পেসাররা ওদের মতো নিরীহ নয়। আমাদের পেসারদের দাপটে স্পিনাররা গুরুত্ব হারাচ্ছে। আমি ভারতের স্পিনারদের নিয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশের সেই সমস্যা নেই। কারণ, ওদের পেসাররা আমাদের মতো অসাধারণ নয়।”
আরও পড়ুন: দুই ইনিংসেই শূন্য! ইডেনে লজ্জার রেকর্ড বাংলাদেশ অধিনায়কের
গোলাপি বলে টেস্টের সময় নিয়েও বক্তব্য রয়েছে ৭৯ বছর বয়সির। ম্যাচের সময়ের পরিবর্তনের পক্ষপাতী তিনি। এমনিতে ইডেনে টেস্ট শুরু হচ্ছে দুপুর একটায়। দ্বিতীয় সেশন শুরু হচ্ছে বিকেল তিনটে চল্লিশে। আর শেষ সেশন শুরু হচ্ছে সন্ধে ছয়টায়। রাত আটটায় খেলা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মন্থর ওভাররেটের জন্য রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলছে ম্যাচ। যা পছন্দ নয় তাঁর। প্রসন্নর যুক্তি, “ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে যদি দেখি, আমার মতামত যদি চান, তবে বলব খেলা পাঁচটায় শুরু হওয়া উচিত, দুপুর একটায় নয়। তা হলেই তো ব্যাপারটা দুই দলের কাছে সমান-সমান হবে। কারণ, শিশির বা ডিউ ফ্যাক্টর তখন চ্যালেঞ্জ জানাবে দুটো দলকেই। আর বিকেল পাঁচটা যদি বড্ড দেরি হয়ে যায়, তবে দুপুর তিনটেয় শুরু হোক খেলা। তার আগে টেস্ট শুরু করা উচিত হবে না। এ বার রাত ১০টা পর্যন্ত খেলা চলুক। এতে হবে কী যে, দুই দলই মোটামুটি একই কন্ডিশনে খেলবে। কেউ বাড়তি সুবিধা বা অসুবিধার সামনে পড়বে না। সেটাই ঠিক হবে।”
ইডেনে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে লিটন দাস, নইম হাসানের মাথায় লেগেছে বল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসেও মহম্মদ মিঠুনের হেলমেটে লেগেছে বল। মুশফিকুর রহিমও একবার হেলমেটে খেয়েছেন। এটা কেন হচ্ছে? গোলাপি বল কি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, নাকি সমস্যা একেবারেই স্কিলের তফাতে? প্রসন্ন বললেন, “বল দেখতে সমস্যা হচ্ছে কি না, তা ঘরে বসে টিভিতে দেখে বলা সম্ভব নয়। এটা মাঠে যারা খেলছে, তারাই বলতে পারবে। তবে আমাদের পেস বোলিং যে খুবই ভাল, তা নিয়ে সংশয় নেই। তাই যে কোনও ব্যাটসম্যানেরই সমস্যা হওয়ার কথা। আর এটা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশ মোটেই শক্তিশালী দল নয়। ভারতকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে গোলাপি বলে টেস্ট খেলতে হবে। তখন দেখা যাবে, দুই দলই চাপে পড়ছে। ইডেনে তো ভারত কখনই চাপে পড়েনি। তাই সঠিক মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে বাংলাদেশ যে দারুণ দল নয়, এটা নিয়ে দ্বিমত নেই। ওদের একমাত্র মুশফিকুর বলে ব্যাটসম্যানটা ভাল খেলছিল। বাকিদের কথা বলার মতো নয়।”
ক্রিকেট কেরিয়ারে অনেক পেসারকে দেখেছেন। খেলা ছাড়ার পরও ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন কোনও না কোনও ভাবে। আর তাই ইশান্ত শর্মা-উমেশ যাদব-মহম্মদ শামি মুগ্ধ করেছেন প্রসন্নকে। বলেই দিলেন, “এখন বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণ এটাই।”
আর এখানেই তো আশঙ্কা। সেরা পেস আক্রমণই যে স্পিনারদের গুরুত্ব হারানোর নেপথ্য কারণ!
আরও পড়ুন: সচিন-পন্টিংয়ের চেয়ে অনেকটাই দ্রুত, ইডেনে ৭০তম সেঞ্চুরি করলেন বিরাট