শাসন: গোলাপি বলে প্রথমবার পাঁচ উইকেট নিেয় সতীর্থদের সঙ্গে ইশান্ত। ছবি: সুদীপ্ত ভোমিক
গঙ্গার বুক থেকে আসা ওই দমকা হাওয়াটা আর ইডেনের বুকে আছড়ে পড়ে না। ইট, কাঠ, কংক্রিটের ভিড়ে সে বহু দিন আগেই আটকে গিয়েছে। তাই তো অনেক প্রবীণ ক্রিকেটারের মুখেই শোনা যায় আক্ষেপটা, ‘‘হাওয়াটাই আর আসে না। পেসাররা বল সুইং করাবে কী করে?’’
শুক্রবার দুপুরে সে বদ্ধ হওয়া যদি কংক্রিটের ওই প্রাচীর ডিঙিয়ে কোনও গতিকে ইডেনের রাস্তা খুঁজে পেত, তা হলে হয়তো অবাক হয়ে ভাবত, এ কোথায় এসে পড়েছি! এ তো এক অচেনা ইডেন। কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় যা বদলে গিয়েছে। যে ইডেনে এক হয়ে গিয়েছে অতীত আর ভবিষ্যৎ।
ঠাসা গ্যালারি দেখে কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছিলেন অতীতের সরণিতে। যখন মাঠ ভরে যেত নিখাদ টেস্ট ক্রিকেটের টানে। আবার কেউ কেউ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন নব্য ইডেনের দিকে। যেখানে গোলাপির আগুনে বরণ করে নেওয়া হচ্ছিল ইতিহাসকে।
ইডেনের দমকা হাওয়া সাক্ষী থেকেছে ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট ধ্বনি’র। দেখেছে, দর্শক রোষের মুখে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের প্রাণ ভয়ে দৌড়। কিন্তু কখনও কি দেখেছে ভারতীয় পেস আক্রমণের মুখে পড়ে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা? দেখেছে কি লাঞ্চের আগে চার স্লিপ, এক গালি নিয়ে ফিল্ডিং সাজাচ্ছেন কোনও ভারতীয় অধিনায়ক? আর নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, কখনও দেখেনি ভারতীয় পেসারের বিষাক্ত বাউন্সারের শিকার হয়ে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে বিপক্ষের দুই ব্যাটসম্যানকে! ইশান্ত শর্মা, মহম্মদ শামি, উমেশ যাদবের হাত ধরে যা দেখল ইডেন!
গোলাপি বল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে গোধূলি লগ্নে। বিষাক্ত সুইং হবে রাত বাড়লে। ইডেনে দিনরাতের টেস্টের আগে এ রকম ভবিষ্যদ্বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল ভাল মতোই। কিন্তু ভারতের পেস ত্রয়ীর গোধূলি পর্যন্ত অপেক্ষা করার বোধ হয় ধৈর্য ছিল না। টস জিতে বাংলাদেশ ব্যাট করার দুঃসাহস দেখানোর পরে প্রথম ঘণ্টায় স্কোর ১১.৫ ওভারে চার উইকেটে ২৬। বিরতিতে ছয় উইকেটে ৭৩। তার পরে ৩০.৩ ওভারে বাংলাদেশ শেষ ১০৬ রানে। ভারতের তিন পেসারের বোলিং হিসেব এ রকম: ইশান্ত ১২-৪-২২-৫। উমেশ ৭-২-২৯-৩। শামি ১০.৩-২-৩৬-২।
আগ্রাসী: বাংলাদেশ ইনিংসকে ভাঙলেন শামিও। এপি
কিন্তু এই পরিসংখ্যানও সম্ভবত ঠিক ছবিটা তুলে ধরছে না। ইশান্ত পাঁচ, উমেশ তিন উইকেট পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আগুন ঝরানো বোলিংটা করে গেলেন শামিই। দিন কয়েক আগেই সুনীল গাওস্কর স্বয়ং ম্যালকম মার্শালের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন শামির। বাংলার এই পেসার শুক্রবারের ইডেনে যে ৬৩টা বল করলেন, তাতে প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে এই বুঝি উইকেট পড়বে বা ব্যাটসম্যান আহত হবেন। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেই ঠকঠকানিটা তুলে দিতে পেরেছিলেন শামি, যেটা দেখা যেত স্বর্ণযুগের ক্যারিবিয়ান পেস আক্রমণের মুখে পড়লে। শামির দুটো বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশের লিটন দাস এবং নইম হাসানকে। তাঁদের বদলে ‘কনকাসন সাব’ (মাথায় চোট পেলে পরিবর্ত হিসেবে যে ক্রিকেটার নামেন) নামলেন মেহদি হাসান মিরাজ এবং তাইজুল ইসলাম। এও প্রথম। এর আগে টেস্টের এক ইনিংসে চোটের জন্য দু’জন ‘কনকাসন সাব’ নামার ঘটনা কখনও ঘটেনি।
ইডেনের বাইশ গজের চেয়ে মাঠের বাইরে যে তারকা সমাবেশ ঘটেছিল, তার ঔজ্জ্বল্য ছিল আরও বেশি। প্রাক্তন অধিনায়কদের তালিকায় কে ছিলেন না! কপিল দেব থেকে শুরু করে সচিন তেন্ডুলকর। রাহুল দ্রাবিড় থেকে অনিল কুম্বলে।
সম্মানিত: সংবর্ধিত প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক কপিল দেব, সচিনেরা। নিজস্ব চিত্র
এমনই এক প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের মনে হয়েছে, শামি যে ভাবে বলের সিমটা (সেলাই) কাজে লাগান, তা ইদানীং কালে কারও মধ্যে দেখা যায়নি। সঙ্গে দুরন্ত গতি। ইডেনে হাজির ছিলেন বাংলাদেশের হাবিবুল বাশার থেকে আক্রম খানরাও। প্রেসবক্সেও ঘুরে যান তাঁরা। তাঁদেরই এক জন বাংলাদেশ ইনিংসের মাঝপথে বলছিলেন, ‘‘যখন কলকাতায় নেমেছিলাম, শরীর-টরীর খুব ভাল ছিল। খেলা দেখার পরে কী রকম খারাপ লাগছে!’’
ভারতীয় দর্শকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্যই উল্টো। কেউ যদি শরীর খারাপ নিয়েও মাঠে আসেন, ঐতিহাসিক দিনরাতের টেস্টের প্রথম দিনের ‘মেনু’ তাঁকে তরতাজা করে দিতে বাধ্য। শুরুতে যদি থাকে ‘শামি কাবাব’, তা হলে মেন কোর্স হল ‘শর্মা’জ কারি’। ইডেনের আগে ঘরের মাঠে টেস্টে ইশান্ত এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন ১২ বছর আগে।
এতে মন না ভরলে ছিল ‘সাহা এবং শর্মা ফ্রাই’ও। মাহমুদুল্লাহের ক্যাচটা ডানদিকে শরীর ছুড়ে ঋদ্ধিমান সাহা নেওয়ার পরে স্লিপে দাঁড়ানো কোহালির ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, অধিনায়ক বিশ্বাসই করতে পারছেন না কী ঘটেছে। এ দিন আবার ১০০ টেস্ট ক্যাচও হয়ে গেল ঋদ্ধির। ঠিক তেমনই অবিশ্বাস্য ছিল রোহিত শর্মার ক্যাচটাও। মোমিনুল হকের খোঁচাটা দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো কোহালির হাতে যখন প্রায় ঢুকে যাচ্ছে, কোথা থেকে রোহিতের হাত এসে সেটা ছো মেরে তুলে নিয়ে গেল।
আর শেষ পাতে মিষ্টি না থাকলে কী জমে! চিন্তা নেই। বিরাট কোহালি আছেন কী জন্য! কোহালির অপরাজিত ৫৯ রানের ইনিংসে যে কভার ড্রাইভটা রয়েছে, সেটা দেখলে তো এমনিতেই শরীরে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাবে! এ দিন অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে দ্রুততম (৮৬ ইনিংসে) পাঁচ হাজার রানের গণ্ডি টপকে গেলেন কোহালি। ভারত এখনই তিন উইকেটে ১৭৪। প্রথম দিনই কোহালি সেঞ্চুরি আর ভারত জয়ের দিকে এগোচ্ছে।
ইডেনে বহু দিন পরে আবার দেখা গেল ভারতীয় ক্রিকেটের সেই অবিস্মরণীয় চারমূর্তিকে। সচিন, সৌরভ, দ্রাবিড় এবং লক্ষ্মণ। তাঁরা সম্ভবত দেখে গেলেন, নতুন চারমূর্তির ছায়া। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি— এই চার ব্যাটসম্যান নন, পেসার।
কিন্তু চার জন কোথায়? ইডেনে তো তিন জনকে দেখা গেল। ঠিক। চতুর্থ জন তো তৈরি হচ্ছেন।
যশপ্রীত বুমরাকে ভুলে গেলেন নাকি?
স্কোরকার্ড
বাংলাদেশ ১০৬ (৩০.৩)
ভারত ১৭৪-৩ (৪৬)
বাংলাদেশ (প্রথম ইনিংস)
শাদমান ক ঋদ্ধিমান বো উমেশ ২৯•৫২
ইমরুল এলবিডব্লিউ বো ইশান্ত ৪•১৫
মোমিনুল ক রোহিত বো উমেশ ০•৭
মিঠুন বো উমেশ ০•২
মুশফিকুর বো শামি ০•৪
মাহমুদুল্লা ক ঋদ্ধিমান বো ইশান্ত ৬•২১
লিটন আহত ও অবসৃত ২৪•২৭
নইম বো ইশান্ত ১৯•২৮
এবাদত বো ইশান্ত ১•৭
মেহদি ক পুজারা বো ইশান্ত ৮•১৩
আল আমিন ন. আ. ১•৪
আবু ক পুজারা বো শামি ০•৩
অতিরিক্ত ১৪
মোট ১০৬ (৩০.৩)
পতন: ১-১৫ (ইমরুল, ৬.৩), ২-১৭ (মোমিনুল, ১০.১), ৩-১৭ (মিঠুন, ১০.৩), ৪-২৬ (মুশফিকুর, ১১.৫), ৫-৩৮ (শাদমান, ১৪.২), ৬-৬০ (মাহমুদুল্লা, ১৯.৪), ৬-৭৩* (লিটন, অবসৃত ন.আ), ৭-৮২ (এবাদত, ২৩.৫), ৮-৯৮ (মেহদি, ২৭.৬), ৯-১০৫ (নইম, ২৯.৫), ১০-১০৬ (জায়েদ, ৩০.৩)।
বোলিং: ইশান্ত শর্মা ১২-৪-২২-৫, উমেশ যাদব ৭-২-২৯-৩, মহম্মদ শামি ১০.৩-২-৩৬-২, রবীন্দ্র জাডেজা ১-০-৫-০।
ভারত (প্রথম ইনিংস)
মায়াঙ্ক ক মেহদি (পরিবর্ত) বো আমিন ১৪•২১
রোহিত এলবিডব্লিউ বো এবাদত ২১•৩৫
পুজারা ক শাদমান বো এবাদত ৫৫•১০৫
কোহালি ন. আ. ৫৯•৯৩
রাহানে ন. আ. ২৩•২২
অতিরিক্ত ২
মোট ১৭৪-৩ (৪৬)
পতন: ১-২৬ (মায়াঙ্ক, ৪.৪), ২-৪৩ (রোহিত, ১২.৫), ৩-১৩৭ (পুজারা, ৩৯.১)।
বোলিং: আল আমিন হোসেন ১৪-৩-৪৯-১, আবু জায়েদ ১২-৩-৪০-০, এবাদত হোসেন ১২-১-৬১-২।