মাত্র তিন বছর বয়সে ছেলেটা হাতে ক্রিকেট ব্যাট তুলে নিয়েছিল। বাবাকে বলেছিল, তাকে বল করতে। একটু বড় হতে বাবা-ই তাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। একটু একটু করে স্বপ্নপূরণের দিকে এগোচ্ছিল ছেলে। একদিন স্বপ্নপূরণের পথে প্রথম ধাপে পা পড়ল। জাতীয় দলে সুযোগ এল। কিন্তু তখন বাবা অনেক দূরে। তার দু’বছর আগেই তিনি চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে।
স্বপ্নপূরণের বৃত্ত শুরু হয়েছিল দিল্লির উত্তমনগরের এক পঞ্জাবি পরিবারে। বাবা, ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। মা, ব্যস্ত স্বামী এবং তিন সন্তানের সংসার নিয়ে। দিল্লির উত্তম নগরে এগোচ্ছিল সংসার। সেখানেই ১৯৮৮ সালের ৫ নভেম্বর জন্ম বাড়ির ছোট ছেলের। মধ্যবিত্ত আবহে বড় হওয়া দাদা বিকাশ ও দিদি ভাবনার সঙ্গে।
১৯৯৮ সালে তৈরি হল ওয়েস্ট দিল্লি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। সেখানে ছোটে ছেলেকে নিয়ে হাজির হলেন উত্তমনগরের ওই আইনজীবী। পড়শিরাই বলেছিল, এই ছেলেকে শুধু গলি ক্রিকেটের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা ঠিক হবে না। কোচ রাজকুমার শর্মার হাত ধরে ন’বছরের ছেলের শুরু হল ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। সে তখন ভারতী পাবলিক স্কুলের ছাত্র।
ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম সুযোগ দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৫ দলে। প্রথম বিদেশ সফর ২০০৬ সালে, অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলের হয়ে। তারপর অপেক্ষা দু’বছরের। ২০০৮ সালে জাতীয় দলের জন্য প্যাড পরার সুযোগ। ডাক এল শ্রীলঙ্কায় ত্রিদেশীয় একদিনের সিরিজের জন্য। তার দু’বছর আগে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একমাস শয্যাশায়ী থাকার পরে মারা গিয়েছেন আইনজীবী প্রেম কোহালি। ছেলে বিরাটের মাথায় জাতীয় দলের নীল টুপি তিনি দেখে যেতে পারেননি।
জাতীয় দলের সুযোগ আসার পরেও যাত্রাপথ খুব একটা মসৃণ ছিল না বিরাট কোহালির। প্রথম দিকে ছিলেন অনিয়মিত। কখনও শিখর ধবন, যুবরাজ সিংহের চোট বা কখনও সচিন তেন্ডুলকরের মতো তারকার বিশ্রাম বিরাটের সামনে জাতীয় দলের দরজা খুলে দিয়েছে। প্রতিটা সুযোগ তিনি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিরাট কোহালি প্রথম নজর কাড়লেন ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে। তখন শ্রীলঙ্কা এসেছে ভারত সফরে। সিরিজের চতুর্থ একদিনের ম্যাচে ইডেন গার্ডেনে শতরান করলেন বিরাট। তিনি ১১১ বলে ১০৭ রান করেন। গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে তাঁর পার্টনারশিপ ছিল ২২৪ রানের।
সেই ম্যাচ ৭ উইকেটে জেতে ভারত। ৩-১ ফলাফলে সিরিজ-ও আসে মেন ইন ব্লু-দের সাজঘরেই। ইডেনে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন গম্ভীর। তিনি ওই পুরস্কার দিয়ে দেন কোহালিকে। কোহালির টেস্ট অভিষেক ২০১১ সালের জুন মাসে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে।
প্রথম সহঅধিনায়কত্বের সুযোগ আসে ২০১২ সালে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে। পরের বছরই একদিনের ম্যাচে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ত্রিদেশীয় সিরিজে তিনি অধিনায়কত্ব করেছিলেন ধোনি আহত হওয়ায়। পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্টে প্রথম অধিনায়কত্ব। সে সুযোগও এসেছিল তৎকালীন অধিনায়ক ধোনি আহত হওয়ায়।
পাকাপাকিভাবে টেস্টে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান ২০১৪ সালে। তার তিন বছর পরে তিনি-ই হন একদিনের ম্যাচে ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়ক। এখনও অবধি ৮২টি টেস্টে কোহালির স্কোর ৭০৬৬ রান। ২৩৯টি একদিনের ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১১,৫২০ রান। ৭১টি টি-২০ ম্যাচে তাঁর নামের পাশে যোগ হয়েছে ২৪৪১ রান। কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ভূষিত হয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানে।
গ্ল্যামারাস ক্রিকেট-জীবনে এসেছে প্রেমও। অনুষ্কা শর্মার আগে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়েছে। দক্ষিণী নায়িকা সাক্ষী আগরওয়াল নাকি বিরাট কোহালির বিশেষ বান্ধবী ছিলেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
২০০৭ সালে মিস ইন্ডিয়া হয়েছিলেন সারা জেন ডায়াস। তিনি ছিলেন অভিনেত্রী, সঞ্চালিকা এবং ভিডিও জকি। এক পার্টিতে আলাপ দু’জনের। সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছড়াতে সময় লাগেনি। কিন্তু যত দ্রুত গুঞ্জন ছড়ায়, তার থেকেও তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় সেই সম্পর্ক।
ব্রাজিলিয়ান মডেল ইসাবেল লেইত অভিনয় করেছেন বলিউডেও। ‘তালাশ’, ‘সিক্সটিন’, ‘পুরানি জিন্স’-এর মতো ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বিরাটের সঙ্গে প্রায় দু’বছর তাঁর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরে দু’জনেই সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন।
বলিউডে পরিচিত মুখ তমন্না ভাটিয়ার সঙ্গে বিরাট কোহালির আলাপ হয়েছিল বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে। শোনা যায়, তাঁরা দু’জনে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। কিন্তু বিরাটের আগের সম্পর্কগুলির মতো এই সম্পর্কও ছিল ক্ষণস্থায়ী।
২০১৩ সালে শ্যাম্পুর বি়জ্ঞাপনের শুটিংয়ে অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে আলাপ বিরাট কোহালির। এরপর বিভিন্ন জায়গায় দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যায়। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যে ‘শুধুই ভাল বন্ধু’-র পরিচয় বজায় রেখেছিলেন বহু দিন।
টানাপড়েন এবং ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে তাঁদের সম্পর্ক। ২০১৬ সালে, বিরাট অনুষ্কার প্রেম ভেঙে গিয়েছে, এ রকম গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে বছরেরে শেষের দিকে যুবরাজ-হ্যাজেলের বিয়েতে তাঁদের যুগল-উপস্থিতি ভেঙে দেয় বিচ্ছেদের সব গুঞ্জন।
এরপর সংবাদমাধ্যমে এই জুটির ‘বিরুষ্কা’ হয়ে ওঠা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ইতালিতে গোপন অথচ স্বপ্নের মতো অনুষ্ঠানে সাত পাকে বাঁধা পড়েন বিরাট কোহালি এবং অনুষ্কা শর্মা। বিয়ের পর কারও কেরিয়ারেই ভাটা পড়েনি। অভিনয়-প্রযোজনার পাশাপাশি গ্যালারিতে ভারতীয় দলের ফার্স্ট লেডির উপস্থিতি দর্শনীয়।
আজ অবধি কোনও সম্পর্ক নিয়েই মুখ খোলেননি বিরাট কোহালি। তাঁর চলার পথে সাফল্যের হাত ধরেই এসেছে বিতর্ক। সে সব কিছু নিয়েই একের পর এক মাইলফলক স্পর্শ করছেন ভারত অধিনায়ক, মা সরোজ কোহালির আদরের চিকু। দিল্লির ভাড়াবাড়িতে থেকে তাঁর উত্তরণ হার মানাবে যে কোনও লড়াকু ইনিংসকেই। (ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া)