স্বপ্ন ভাঙার সেই মুহূর্ত। ম্যাকমিলানকে সান্ত্বনা জানাচ্ছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ। —ফাইল চিত্র।
সেটা ছিল ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর। ২১ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার পর, ইডেন গার্ডেন্সে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বহু ইতিহাসের সাক্ষী ইডেনে এই ২২ নভেম্বর লেখা হতে চলেছে আরও একটা ইতিহাস। ভারতে প্রথম গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ হবে। ২৮ বছর আগে সেই ঐতিহাসিক দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সদস্য ছিলেন ব্রায়ান ম্যাকমিলান। আনন্দবাজার ডিজিটাল-এর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময়ে পুরনো সেই দিনের স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি, টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ফরম্যাট নিয়েও মতামত দিলেন দীঘল চেহারার প্রাক্তন প্রোটিয়া আলরাউন্ডার।
নির্বাসন কাটিয়ে এই ইডেন গার্ডেন্সেই শাপমুক্তি ঘটেছিল আপনাদের। সে দিনের কথা ভাবতে বসলে নিশ্চয় এখনও গায়ে কাঁটা দেয়?
অবশ্যই। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কোনও মতেই সম্ভব নয়। বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই শহরের পালসটা বুঝতে পারছিলাম। রাস্তার দু’ পাশে প্রচুর মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন। ইডেন গার্ডেন্সে খেলতে নেমে তো আমরা রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। প্রায় ৯০ হাজারের মতো দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন সে দিন। আমরা এর আগে এত দর্শকের সামনে খেলিইনি। কপিলদেব, সচিন তেন্ডুলকর, মহম্মদ আজহারউদ্দিনকে নিয়ে তৈরি ভারতীয় দল খুবই শক্তিশালী ছিল। ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু, সেই ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত আমরা উপভোগ করেছিলাম। প্রথম দর্শনেই ইডেন আমাদের মুগ্ধ করেছিল। নিউজপেপার পড়ে এখন জানতে পারছি যে ইডেনেই আবার একটা ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে।
গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ খেলা হবে। ভারতের মাটিতে এই প্রথম এমন ফরম্যাটের টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে। একজন প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং ক্রিকেটভক্ত হিসেবে ম্যাচটা নিশ্চয় আগ্রহ নিয়ে দেখবেন?
টেলিভিশনে টেস্ট ম্যাচটা অবশ্যই দেখব। ম্যাচটা নিয়ে আমার খুবই আগ্রহ রয়েছে। আমি জানি ভারতে এই প্রথম বার দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ হতে চলেছে। দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ, গোলাপি বলে খেলা ভারতে দারুণ জনপ্রিয় হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এর আগে আইপিএল-এর জন্ম দিয়েছে ভারত। মানুষ দারুণ ভাবে গ্রহণ করেছে আইপিএল। এখন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ক্রিকেট সারা বিশ্বেই খেলা হয়। কিন্তু, আইপিএল-এর মতো জনপ্রিয়তা অন্য কোনও টুর্নামেন্ট পায়নি। ভারতের মানুষ ক্রিকেট অন্ত প্রাণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ জমে যাবে আপনাদের দেশে।
আরও পড়ুন: রাতে দেখতে সুবিধা, জেল্লা থাকে অনেকক্ষণ, গতি-বাউন্স বেশি, অনেকটাই আলাদা গোলাপি বল
কিন্তু, সারা বিশ্বে তো টেস্ট ম্যাচের প্রতি মানুষের ভালবাসা কমছে। গ্যালারি থাকে ফাঁকা। প্রথমে ওয়ান-ডে, তার পর টি টোয়েন্টি ক্রিকেট থাবা বসিয়েছে টেস্টের উপরে। ধুমধারাক্কা ব্যাটিং দেখার জন্যই তো মাঠে আসছেন দর্শকরা। ঠুকঠুক করে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ কেন দেখবেন দর্শকরা?
কী বলছেন! টেস্ট ফরম্যাটই তো সব চেয়ে পুরনো। টেস্ট ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটারকে যথার্থ পরীক্ষা দিতে হয়। সেই কারণেই তো এর নাম টেস্ট। আমি মনে করি টেস্ট ক্রিকেটই হল ফাউন্ডেশন। সব ফরম্যাটের ক্রিকেটের ফাউন্ডেশন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অনেকে ধুমধাম ব্যাট চালিয়ে রান করছে ঠিকই। অনেকে তো আবার ক্রিকেটীয় শট খেলেই রান করছে। আপনি যদি গ্রামার জানেন, তা হলে গ্রামার ভাঙতেও পারবেন। আমি মনে করি টেস্ট ক্রিকেট গ্রামার নির্ভর খেলা। গ্রামার যদি আপনার জানা থাকে, তা হলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আপনি গ্রামার ভেঙেও সফল হতে পারবেন। এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই জগঝম্প হচ্ছে ঠিকই। তবে মাদার ফরম্যাট কোনও দিনই হারিয়ে যাবে না।
নির্বাসন কাটিয়ে ফিরেই ক্লাইভ রাইসরা নেমে পড়েছিলেন ইডেন গার্ডেন্সে। —ফাইল চিত্র।
১৯৯১ সালের ইডেন গার্ডেন্স। শিহরণ জাগানো অনুভূতি ছিল আপনাদের। ঠিক ২ বছর পরের ইডেন দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল আপনাদের জন্য। হিরো কাপের সেমিফাইনালে শেষ ওভারে জেতার জন্য ৫ রান দরকার ছিল আপনাদের। সচিনের ওভারে সেই রানও তুলতে পারলেন না।
মনে থাকবে না কেন! নন স্ট্রাইক এন্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ডোনাল্ড একের পর এক বল নষ্ট করছে। জেতা-হারার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বল নষ্ট করে, তা হলে তো বিরক্তি আসবেই। লাস্ট বলটায় আমিও বাউন্ডারি মারতে পারলাম না। সে দিন আমার খুব খারাপ লেগেছিল।
দুর্ভাগ্য আপনাদের চিরসঙ্গী। ১৯৯২ বিশ্বকাপে ১ বলে জেতার জন্য আপনাদের দরকার ছিল ২২ রান। ২০০৩ বিশ্বকাপে শন পোলক ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ঠিকমতো ক্যালকুলেশনই করতে পারলেন না। কেন বারবার আপনাদের ক্ষেত্রেই এমন সব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটে?
আপনি তো আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়তে পারবেন না! ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে আমাদের জন্য সমীকরণ একাধিকবার বদলাল। ফাইনালে পৌঁছনোর জন্য একসময়ে আমাদের সমীকরণ দাঁড়ায় ১৩ বলে ২২ রান। পরে সেই সমীকরণই বদলে দাঁড়ায় ১ বলে ২২ রান। ওই রান তোলা কি কারওর পক্ষে সম্ভব? পাকিস্তান অন্য দিক থেকে ফাইনালে উঠেছিল। আমরা কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কনফিডেন্ট ছিলাম। কিন্তু, কী আর করা যাবে। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ঠিকঠাক ক্যালকুলেট করা গেল না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ডোনাল্ড অন্ধের মতো রান আউট হয়ে গেল। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে আমাদের ভাগ্যই খারাপ।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়ান বথাম বলা হত ম্যাকমিলানকে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপ্লব ঘটিয়েছিল। আপনাদের প্রাক্তন কোচ বব উলমার বলতেন— ওয়ানডে ম্যাচে চার-ছক্কা মারার দরকার নেই। প্রতি বলে সিঙ্গল নাও। তাহলেই তিনশো বলে তিনশো করতে পারবে। সেই দক্ষিণ আফ্রিকার আজ এই হাল কেন? হতশ্রী পারফরম্যান্স করল বিশ্বকাপে। ভারতের মাটিতে টেস্ট ম্যাচ খেলতে এসে ভরাডুবি ঘটল।
হ্যাঁ, উলমার আমাদের সেই কথাই বলতেন। আমরাও সেটা মেনে চলতাম। আপনি বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের গ্রাফ এখন পড়তির দিকে। সব দেশের ক্রিকেটেই তো উত্থান-পতন ঘটছে। এটাই নিয়ম। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান — যে দিকেই তাকাবেন, সেখানেই একই জিনিস লক্ষ্য করবেন। সাউথ আফ্রিকায় এখন পলিটিক্স সর্বত্র। দেখতে হবে, খেলায় যাতে রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। খেলাধুলো হবে রাজনীতি মুক্ত একটা ব্যাপার। আমিও তো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। কিন্তু, এখন তা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: গোলাপি বলে প্র্যাকটিসের ফাঁকেই জয়সূর্যর বোলির অ্যাকশন নকল অশ্বিনের, দেখুন ভিডিয়ো
বিশ্বকাপের কয়েক দিন আগে আপনাদের ক্যাপ্টেন ফ্যাফ দু’প্লেসিকে ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করে বসেন এবি ডিভিলিয়ার্স। বিশ্বকাপে খেলার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন এবিডি। দু’প্লেসি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, দল তৈরি হয়ে গিয়েছে বিশ্বকাপের। এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়।
(প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে) আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করছি। বিরাট কোহালিকে বাদ দিয়ে কি আপনারা বিশ্বকাপের দল গড়বেন? করবেন না তো। তা হলে ডিভিলিয়ার্সকে কেন নেওয়া হল না? আপনাদের হয়ে বিশ্বকাপে ভাল খেলল কে যেন?
—রোহিত শর্মা।
(রোহিতের নাম শোনার পরে ) হ্যাঁ, শর্মা। আমার মতে এই মুহূর্তে বিশ্বক্রিকেটে কোহালি, শর্মা আর এবি ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান। ডিভিলিয়ার্সকে না নেওয়া শুধু ভুল সিদ্ধান্তই নয়, অত্যন্ত সস্তা দরের সিদ্ধান্ত।