তিনি কি সসাগরা ক্রিকেট সাম্রাজ্যের একদা অধিপতি? না অধুনা যন্ত্রণাকাতর এক নেতা যাঁর চোখের সামনেই সাম্রাজ্যের পরোয়া করছে না তাঁরই সৈনিকেরা?
হেঁয়ালিটা পরিষ্কার করার আগে জানাই, সিডনি ক্রিকেট মাঠের ভেতরে বিখ্যাতদের সম্মানিত করার একটা সরণি আছে। অনেকটা লস অ্যাঞ্জেলিসে যেমন হলিউড ওয়াক অব ফেম। তেমনি। এর নাম ওয়াক অব অনার..।
এত সব বিখ্যাত বিখ্যাত প্লেয়ার খেলেছেন নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে যে ওয়াক অব অনারে কাকে ছেড়ে কাকে রাখবে এসসিজি ট্রাস্ট! তাও পরপর ওদের নামগুলো রয়েছে ভিক্টর ট্রাম্পার, ফ্রেডরিক স্পোফোর্থ, জ্যাক গ্রেগরি, অ্যালান ডেভিডসন, রে লিন্ডওয়াল, কিথ মিলার, আর্থার মরিস, ববি সিম্পসন, নর্ম্যান ও’নিল, ডগ ওয়াল্টার্স। এই সম্মান সরণি পেরিয়েই প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমের দিকে এগোলে দু’দিকে দুটো ব্রোঞ্জ মূর্তি। একটা রিচি বেনো। অন্যটা স্টিভন ওয়।
এই রাজ্য দলের হয়েই তো খেলেছেন পন্টিং, ম্যাকগ্রা, মার্ক ওয়, ব্রেট লি-রা। পরবর্তীকালে এঁদেরও নিশ্চয়ই অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হবে ওয়াক অব অনারে। কিন্তু এখনও কোথাও গিয়ে স্টিভন ওয় তিনি এক দিকে। বাকিরা আর এক দিকে।
আশ্চর্যের কথা, বাকি ক্রিকেটবিশ্ব বা সিডনি গ্রাউন্ড ট্রাস্ট তাঁর অবদান যত প্রাতঃস্মরণীয় মনে করুক না কেন, খোদ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহলেরই একটা অংশ তার সঙ্গে একমত নয়। এরা মনে করে স্টিভ ওয় এক চূড়ান্ত ভাগ্যবান নেতার নাম। যিনি দারুণ টিম পেয়েছিলেন বলে এত দারুণ রেকর্ড গড়তে পেরেছেন। তাঁর ম্যাকগ্রা আর ওয়ার্ন ছিল। এমন দু’জন ম্যাচ উইনিং বোলার থাকলে যে কোনও ক্যাপ্টেনই জিতত।
ইয়ান চ্যাপেলের মতো কেউ কেউ আর এক ধাপ এগিয়ে আজও বলে যাচ্ছেন, স্টিভ হল এক জন স্বার্থপর ক্রিকেটার। যে সব সময় নিজের স্ট্যাটস, নিজের রান নিয়ে ব্যস্ত থাকত। চাপ নেবে না বলে কোনও দিন ছয় নম্বরের ওপরে ব্যাট করতে যায়নি। অমন সোনার টিম চাপটাপ সামলে দেওয়ার পর বাবু ব্যাট করতে যেতেন।
শুনে ক্রিকেটভক্তদের অবিশ্বাস্যই লাগতে পারে। ছয় নম্বরে খেলা মানে টেস্টে দ্বিতীয় নতুন বল যে কোনও সময় খেলার জন্য তৈরি থাকা। অর্ধেক সময় টেল এন্ডারদের নিয়ে ব্যাট করা। ভারতীয় দলে যা করতেন ভিভিএস লক্ষ্মণ। কেউ কখনও বলেনি লক্ষ্মণ স্ট্যাটিস্টিক্স বাড়াতেন নীচে খেলে। শুধু স্ট্যাটিস্টিক্স লক্ষ হলে স্টিভ কি ১৬৮ টেস্ট ম্যাচে ১০৯২৭ রান করতে পারতেন, ৫১.০৬ গড় রেখে?
কিন্তু আলোচনাটা সিডনির বিশ্বখ্যাত অপেরা হাউসের মতোই স্টিভের ক্রিকেট নিয়ে বয়েই চলেছে। আরও একটা তর্ক ক্রমাগত চলে—স্টিভ কি সত্যিই বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক?
তাঁর দলের অনেকেই এখন কখনও প্রকাশ্যে কখনও অপ্রকাশ্যে স্টিভ সম্পর্কে বিষোদগার করে থাকেন। স্টিভের বিশ্বজয়ী সেই দলটা অদ্ভুত ভাবে দুটো গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গিয়েছে এই বারো বছরের মধ্যেই।
এক দিকে স্টিভ, গিলক্রিস্ট, ম্যাকগ্রা, লেম্যান, ল্যাঙ্গার। উল্টো দিকে ওয়ার্ন, পন্টিং, কাটিচ, ক্লার্ক। নিরপেক্ষ হেডেন, মার্ক ওয়, ব্রেট লি। স্টিভের অধীনে ক্লার্ক কখনও খেলেননি। কিন্তু ঠিক গায়ে গায়েই তাঁর এসে পড়া। আর গত দশ বছর ধরে ক্লার্ক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে অত্যন্ত প্রভাবশালী চরিত্র। তাঁর অবস্থান কোন দিকে সেটা সামগ্রিক পাওয়ার ইকুয়েশনে একটা ফ্যাক্টর তো বটেই।
স্টিভ-বিরোধের সবচেয়ে বড় মুখ ইয়ান চ্যাপেল আর শেন ওয়ার্ন। ইয়ান চ্যাপেল মনে করেন স্টিভ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে কোনও সংস্কার করে যাননি। একটা গ্রেট টিম হাতে পেয়ে সাম্রাজ্যের পরম্পরা বহন করেছেন মাত্র। ইয়ান মনে করেন, স্টিভের এই নিজেকে আগে দেখো মানসিকতা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের আদর্শ বিরোধী। যা টিমগেম শেখায় না।
চ্যাপেলকে এর জবাব স্টিভের কোনও বিশ্বস্ত সৈনিকই দিতে পারতেন। বা চ্যাপেলের টিমের বিক্ষুব্ধ কেউ। কিন্তু কেউ মুখ খোলেননি। আরও ইন্টারেস্টিং চ্যাপেলের টিমের তারকা যাঁরা সেই লিলি, মার্শ, টমসন, ওয়াল্টার্স, ম্যালেট, গ্রেগ চ্যাপেলরা আজও ইয়ানকেই তাঁদের নেতা মনে করেন। এঁদের সম্পূর্ণ আনুগত্য আজও ভোগ করেন ইয়ান চ্যাপেল।
স্টিভের তাই শোনা ছাড়া বিশেষ উপায় থাকে না। বেশ কিছু দিন অবশ্য ইয়ান চ্যাপেল কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে স্টিভ সেই আমন্ত্রণ এড়িয়ে চলেন। স্টিভকে প্রধান অতিথি করলে কেউ ইয়ানকে ডাকেন না। ওয়ার্ন হলেন ইয়ানের আধুনিক অনুগত সৈনিক। আর কমন ফ্যাক্টর স্টিভ বিরোধিতা। ওয়ার্ন মনে করেন স্টিভের অধিনায়কত্বে গণ্ডগোল না থাকলে ২০০১-০২-এর সিরিজ তাঁরা ভারত থেকে হেরে ফিরতেন না। স্টিভ নাকি অনেক আক্রমণাত্মক ফিল্ড সাজিয়েছিলেন যাতে ভারতীয় স্ট্রোক প্লেয়ারদের দ্রুতগতিতে রান করতে সুবিধা হয়েছিল। নেতা হিসেবে ওয়ার্নের সমর্থন পন্টিংয়ের দিকে। ওয়ার্ন একই সঙ্গে গিলক্রিস্টকেও তীব্র অপছন্দ করেন।
ওয়ার্ন-বিরোধীদের মতে স্টিভের প্রতি তাঁর এত রাগের কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের শেষ টেস্টে তাঁকে বাদ দেওয়া! ১৯৯৯-এর সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ওয়ার্ন একেবারেই ফর্মে ছিলেন না। ওজনও বেড়ে গিয়েছিল। স্টিভ তাঁকে শেষ টেস্টে বাদ দেন। কিন্তু সেই অপমান কখনও ভোলেননি ওয়ার্ন। খেলা ছেড়ে দেওয়ার এত বছর বাদেও তিনি আর স্টিভ সম্পূর্ণ দুটো পৃথক গোষ্ঠীতে বিচরণ করেন। ওয়ার্নের ধারাভাষ্য বা লেখা যে কোনও কিছুতে পুরনো আমল এলেই সাবেকি নেতা সম্পর্কে দু’একটা বক্রোক্তি থাকবেই। ওয় আজ অবধি কোনও উত্তর দেননি। অফ স্টাম্পের বাইরে ছেড়ে দেওয়া লেগ স্পিনের মতো জাজমেন্ট দিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকেরা অবশ্য অনেকেই বলছেন, এটা কী করে ওয়ার্ন বলছে? স্টিভ কিছু করেনি? হেডেন আর ল্যাঙ্গারের ওপেনিং পার্টনারশিপ তৈরি করল কে? ম্যাকগ্রাকে উৎসাহ দিয়ে দিয়ে বড় করে তোলা? গিলক্রিস্টের ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা, ব্যাগি গ্রিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা পুরোটাই তো স্টিভ! অন্তত অঙ্কের হিসেবে অধিনায়ক স্টিভ ওয়র সঙ্গে পৃথিবীর আর কারও তুলনা চলে না। ৫৭ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ৪১টায় জিতেছেন। ক্লাইভ লয়েড সেখানে ৭৪ টেস্টে মোটে ৩৬। নিছক অঙ্কে স্টিভ সবার আগে।
তবু অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সমাজে তাঁর নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা নেই। এই যে সে দিন ক্লার্কের টিমকে উদ্দীপ্ত করে এলেন, সেটাও কোচ ডারেন লেম্যান তাঁকে চেয়েছিলেন বলে! ক্লার্ক চেয়েছিলেন কি না এখনও কেউ খবর বার করতে পারেনি।
ভাবাই যায় না অবসরের এত পরেও ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বে তারকাদের মধ্যে এখনও এত না নেভা আগুন বেঁচে থাকতে পারে। এই সব ব্যর্থ দলের ক্ষেত্রে অনেক সময় হয়। সাফল্য না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরবর্তীকালে ক্রিকেটাররা নানা অপ্রিয় প্রসঙ্গ টেনে আনেন। স্টিভের টিম তো সর্বকালের অন্যতম সেরা। তার মধ্যে এত অশান্তি যে লুকিয়ে ছিল সেটা আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য হল এত বছর বাদেও অশান্তিগুলো যে প্রাসঙ্গিক থেকে গিয়েছে। পন্টিং এই বিবাদে সরাসরি কখনও জড়াননি। কিন্তু স্টিভের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই পেশাদার। স্টিভ যদিও বারবার বলেছেন, তাঁর ছেলে বাবা কী ক্রিকেট খেলত জানে না কিন্তু সে পন্টিংয়ের বিশাল ফ্যান, তাতে হয়তো পারস্পরিক সৌজন্য সামান্য মধুর হয়েছে। কিন্তু দারুণ হৃদ্যতা দুজনের গড়ে ওঠেনি।
প্লেয়ার-প্লেয়ারে গণ্ডগোল, দলাদলি এগুলো চিরকাল ক্রিকেটে উপমহাদেশীয় রোগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পিটারসেনের ঘটনার পর সেই রব খানিকটা বন্ধ হয়েছে। তবে উপমহাদেশেও কপিল-গাওস্কর পরবর্তীকালে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছেন। পাকিস্তানে ইমরান-মিয়াঁদাদ বিরোধ অন্তত সাময়িক ভাবে বন্ধ। তা হলে অস্ট্রেলীয়রা আজও লড়ে যাচ্ছেন কেন?
স্টিভের বিশ্বজয়ী দলের টানা আধিপত্যের মতোই এই প্রশ্নটাও রহস্য হয়েই হয়তো থেকে যাবে।