ফাইলচিত্র
সালটা ১৯৯০। ফেডারেশন কাপ খেলার জন্য কৃশানু-বিকাশদের পাঠিয়ে দিয়েছি চেন্নাই। চিমা, মইদুল ইসলাম এবং আর একজন তরুণ ফুটবলার যাবে পরের দিন।বিমান বন্দরে আমি ওদের এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখি, মোহনবাগানের দুই শীর্ষকর্তা বসে আছেন। তার আগে দু’রাত ঘুমাইনি।তখনকার দিনে ওরকমই হত। রাত জেগে ফুটবলারদের তুলতে হত।
যাইহোক, বিমানবন্দরে মোহন বাগানের দুই দুঁদে কর্তাকে দেখে আমার সন্দেহ হল। কী ব্যাপার? ওরা এখানে বসে কেন? কোথায় যাচ্ছে? বুঝতে পারলাম, চেন্নাই যাচ্ছে। একটু পরেই এক রিপোর্টারের ফোন পেলাম— মোহনবাগানের দুইকর্তা যাচ্ছে কৃশানু-বিকাশকে তুলেনিতে। সব্বনাশ। আমার মাথায় হাত! সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরের এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ব্যবস্থা করে চেন্নাই গামী বিমানে উঠে পড়লাম।ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের পাশে আমাকে একটা সিট করে দিয়েছিলেন উনি।উঠেই দেখলাম, মোহনবাগানের দুইকর্তাও বসে আছে। বুঝলাম, সন্দেহ একেবারেই অমূলক নয়।
চেন্নাই নেমে আমি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে স্টেশনের পাশে একটি হোটেলে এসে উঠলাম। ইস্টবেঙ্গল টিম উঠেছিল এগমোরের কাছে।টিমের হোটেলে গিয়ে দেখলাম, কৃশানু-বিকাশ ওখানে নেই। পাশেই আর একটি হোটেল ছিল। সেখান থেকে দেখি অতনু ভট্টাটার্য আসছে।আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার তুমি এখানে? কৃশানু-বিকাশ কোথায়? ওতখন আমাকে দেখে কেঁদে ফেলল।বলল, ‘‘আমি ওদের ওখান থেকেই আসছি।আপনি আর ওদের পাবেন না। ওদের মোহন বাগান তুলে নিয়েছে। এই হোটেলেই আছে। ওরা কাল সকালবেলায় বিশাখাপত্তনম চলে যাবে।’’
তারপরে আমি যে তাণ্ডবনৃত্য করতাম দলবদলের সময়, তাই শুরু করে দিলাম। ঘরটার নম্বর জোগাড় করে সোজা হানা দিলাম। দরজা খুলে দেখলাম, দু’জনে বসে আছে। কৃশানু-বিকাশকে বললাম, কী হচ্ছে এটা? ওদের বৌ ছিল সঙ্গে।ওরাও চায়না ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে স্বামীরা যাক মোহনবাগানে।বিকাশ উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘আমরা যেতে চাইনা। ইস্টবেঙ্গলেই খেলতে চাই। তুমি আমাদের নিয়ে চলো।’’ তখন মোহনবাগানের দুই কর্তা কে বললাম, ‘‘তোমরা মনে করেছিলে ম্যাচ জিতে গিয়েছ। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে হারতে দেননি।ম্যাচটাই মাঠেই হবে।’’
ফুটবলের ভাষায় যেটাকে বলে ‘গোললাইন সেভ’, সেটাই সেদিন করতে পেরেছিলাম। একই জামাকাপড়ে, চপ্পল পরে বিমানবন্দর থেকেই যদি বেরিয়ে না যেতাম, আর হয়তো রাখাই সম্ভব হতনা কৃশানু-বিকাশকে।মনে আছে মইদুলের কাছ থেকেপায়জামা-পাঞ্জাবি ধার করে পরে চেন্নাইয়ের রাস্তায় আমার দুই ফুটবলারকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম, কৃশানুকে দিয়ে চিমাকেও ওরা হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল।তখন ওটো কেন প্রথার কথা কেউ ভাবতেই পারেনি। কলকাতার ফুটবলে দলবদলের আসর এমনই জমজমাট ছিল। কখনও ইস্টবেঙ্গল ছিনিয়ে নিতে চাইছে, কখনও মোহনবাগান। কৃশানু-বিকাশকে যখন ছিনিয়ে নিচ্ছি প্রতিপক্ষের গ্রাস থেকে, তখন দুইকর্তা আমাকে বলছেন, ‘‘তুমিতো বেঙ্গালুরু থেকে বাবুমানিকে তুলে এনেছ? তাহলে আমাদের দোষকোথায়?’’ ওদের বললাম, তোমাদের মতো আমি ঘুমিয়ে আছি নাকি?
এরপরে ফেডারেশন কাপ খেলতে ত্রিশূর চলে গেলাম। সেখানে ১-৩ হেরে গেলাম সালগাওকরের কাছে। আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করলাম, আমার এই টিম সারাবছর টানতে পারবেনা। ডানদিকটা দুর্বল।তখন আমিই লিয়াসপাসাকে টার্গেট করলাম।সেমিফাইনালে হারার পরে বাকিদের ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আমি বেঙ্গালুরু চলে গেলাম। বাবুমানিকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম পাশার কাছে। আমি ওর সঙ্গে মস্তান আমেদকেও নেব ঠিক করলাম। কারণ, তরুণ বা মনোরঞ্জন যদি কোনও কারণে বসে, তাহলে আমাদের শক্তপোক্ত ডিফেন্ডার দরকার হবে। কিন্তু ওরা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিল।আমি ওদের তুলে এনে হোটেলের ঘরে তালাচাবি মেরে রেখেদিলাম। মস্তান আমেদের মাকে দিয়ে ছেলেকে বোঝালাম। এদিকে, আমার হোটেলে প্রতিপক্ষ শিবিরের লোকেরা এসে হানা দিয়েছে। এসে বলছে, ‘‘গড়গড়িদা আপনি আমাদের প্লেয়ার তুলেনিয়ে এসেছেন ছেড়েদিন।’’ আমি বললাম, ‘‘তুই কি পাগল হয়েছিস? আমাদের তো সব প্লেয়ার রয়েছে। তোদের থেকে নিতে যাব কেন? ভাগ এখান থেকে।আমি ওসব করবনা।’’ আমি সেইসময়ে দু’টো টিকিট কেটে রেখেছিলাম। একটা চেন্নাইয়ের। ওরা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের অফিস থেকে চেন্নাইগামী উড়ানে ফুটবলারদের নাম দেখে ওটাই তাড়া করল।আসলে ওটাছিল ‘ফল্স’। আমি সকালের চেন্নাইয়ের ফ্লাইটে যাবই না। দুপুরে ওদের নিয়ে হায়দরাবাদ চলে গেলাম।তারপরে হায়দরাবাদ থেকে রাতের বিমানে এলাম কলকাতা। তারপরেও মহমেডান সহজে ছাড়েনি। ওদের কর্তারা হুমকি দিতে থাকল, কিছুতেই সই করতে দেব না ওদের।আমাদের দু’টো ফুটবলার তুলেনিয়েছে ওরা। কিন্তু ফুটবলার যখন আমার কব্জায়, সই আমি করিয়েই ছাড়ব।
এ রকম অনেক ধোঁকাবাজি করতে হয়েছে দল গড়তে গিয়ে। কিন্তু এতদিন পরে অস্বীকার করব না, অনেক বেশি নাটকীয় আর রোমাঞ্চে ভরাছিল সেইসময়। মোহনবাগানের সঙ্গে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আমাদের। কিন্তু মাঠের বাইরে সৌজন্য আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটূট ছিল।একটা ঘটনার কথা বলি। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোষাগারে টাকা নেই। লতামঙ্গেশকরকে রাজি করালাম অনেক কষ্টে। কিন্তু কোথায় হবে অনুষ্ঠান? ইস্টবেঙ্গল মাঠের অনুমতি পাওয়া গেল না। তার পরে মোহনবাগান ক্লাবের দিক থেকে ঘুরিয়ে ইস্টবেঙ্গল র্যাম্পার্টের দিক থেকে লতাদিদিকে ঢুকিয়েছিলাম।পঁয়ত্রিশ জন বাদ্যযন্ত্রী এসেছিলেন। আরও চারজন ছিলেন কোরাসের জন্য। সঙ্গে হরিহরণকে এনেছিলাম আমরা। অমিতকুমার গেয়েছিল কিশোরকুমারের গানগুলি।একবার লতাদির সঙ্গে আলোচনার সময় মান্নাদের কথা উঠেছিল। কিন্তু মান্নাদা আসতে চাইতেন না। তখন হরিহরণের নাম চূড়ান্ত হল।রেডরোডের ওখান থেকে আলো আনতে হয়েছিল। ফুল এয়ারকন্ডিশন্ড গ্রিনরুম তৈরি করা হয়েছিল। এখন ভাবলে মনে হয়, ইস্টবেঙ্গল মাঠে লতামঙ্গেশকরকে এনে অনুষ্ঠান করানোর কথা আর কি ভাবা সম্ভব হবে? তা-ও কী, অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে আবার দিদি বললেন, ‘‘কানে ব্যথা হচ্ছে। যেতে পারব কিনা জানিনা।’’ আমার মাথায় হাত। বললাম, যেতে তো হবেই, না হলে আমার আর কিছু আস্ত থাকবেনা ওখানে ফিরলে।শেষ পর্যন্ত কোনও ঝুঁকি না নিয়ে দিদির ডাক্তারকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম।
তবে আমি তখন ক্লাবকে বললাম, শুধু টাকা তোলার জন্য অনুষ্ঠান করাটা ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে শোভা পায় না। বললাম, প্রি-প্ল্যাটিনাম পূর্তি করাহোক।তার জন্য আমরা ফুটবল টুর্নামেন্টও করি চলো। জ্যোতিষ গুহের নামে হোক টুর্নামেন্ট। এআইএফএফ অনুমতি দিয়েদিল। মোহনবাগানকে বললাম, খেলার জন্য। জ্যোতিষ গুহের নামে হবে শুনে সঙ্গে সঙ্গে ওরা রাজি হয়েগেল। একটি পয়সাও নেয়নি খেলার জন্য। মহমেডান খেলতে রাজি হল।জেসিটি এল। ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী বলেছিলেন, ঢাকা মহমেডান স্পোর্টিংকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিসা আর দেয়না ওদের।তা নিয়ে আর এক নাটক। আমি ভিসা ছাড়া চলে গেলাম ঢাকা। বিমানবন্দরে নামতেই গ্রেফতার হয়ে গেলাম। ঢাকার পরিচিত একমন্ত্রীকে ফোনে ধরে বললাম, সমস্যার কথা। তিনি প্রথমেই আঁতকে উঠে বললেন, এ কী করছ? আইসাপড়লাই হল নাকি?
ওদিকে টুর্নামেন্টের আর চারদিনও বাকি নেই। শেষ পর্যন্ত দু’দিন শর্তসাপেক্ষে থাকার অনুমতি পেলাম।ঢাকা মহমেডানের ফুটবলারদের ভিসা জোগাড় করে ওদের সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম। টুর্নামেন্টও হইহই করে হল।
সঙ্গীত বা অনুষ্ঠানের কথা এলে অবশ্য একজনের কথা খুব মনে পড়ে যায়। রাহুলদেব বর্মণ।বা বা কিংবদন্তি শচীন দেববর্মণের হাত ধরে যিনি এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে এবং বারার মতোই লাল-হলুদ ছিল ওঁর হৃদয়ে।মুম্বই গেলে আমার হোটেলে থাকাই হতনা বেশি কারণ আরডি ঠিক আমাকে ওঁর বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতেন। নিজে গাড়ি নিয়ে এসে নিয়ে গিয়েছেন কতবার।তারপর ওঁর বাড়িতে বসে পানাহারের সঙ্গে আমরা পেলের ফুটবল খেলা দেখতাম। পেলের খুব বড়ভক্ত ছিলেন আরডি। সবমিলিয়ে ফুটবল অন্তপ্রাণ ছিলেন।আর ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানে সবকিছু ফেলেদিয়ে ছুটবেন। নিজে দারুণ রান্না করতেন। ডার্বি জেতার আনন্দে রান্না করেও খাইয়েছেন।আমাদের ক্লাবের সদস্য হিসেবে নানা সময়ে অনেক সাহায্যও করেছেন। বাবার নামে ট্রফি দিয়েছেন। টুর্নামেন্ট করতে অর্থ সাহায্য করেছেন। একবার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হিসেবে স্কুটার দিয়েছিলেন।তবে সেবারই আমরা হেরে গিয়েছিলাম সেমিফাইনালে। খুব ভেঙে পড়েছিলেনতাইপুরস্কারদিতেএসে।
ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ উপলক্ষে কত পুরনো কথাই না মনে পড়ে যাচ্ছে। আর এই মহা লগ্নে ক্লাবের কাছে পুরনো এক লাল-হলুদ যোদ্ধা হিসেবে আমি একটাই প্রার্থনা করব। শতবর্ষে আইলিগ এনে আমাদের খুশির আবিরে রাঙিয়ে দিয়ে যাও!