শিক্ষক: অনুশীলনে প্রতিনিয়ত অভিনবত্ব এনে ফুটবলারদের মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে অনায়াসে সাফল্য ছিনিয়ে নিতেন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সফল কোচ পিকে। ফাইল চিত্র
এই মুহূর্তে মুম্বইয়ে মেয়ের বাড়িতে রয়েছি। গত কয়েক দিন ধরেই খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারছিলাম, আমার প্রিয় কোচ প্রদীপ (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায় শারীরিক ভাবে ভাল নেই। হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু শুক্রবার ভরদুপুরে যে দুঃসংবাদটা পেলাম, তা শোনার পরে মনে হল দ্বিতীয় বার পিতৃবিয়োগ হল। প্রদীপদা আমার কাছে এতটাই শ্রদ্ধার জায়গায় ছিলেন সারা জীবন।
প্রদীপদার কথা প্রথম শুনি আমার মেজদা অনিল গড়গড়ির কাছে। তিনি প্রদীপদার সঙ্গে ইস্টার্ন রেলে খেলতেন। তখন আমি স্কুলে পড়ি। দাদার দেওয়া ডে-স্লিপ নিয়ে খেলা দেখতে গিয়েই আমি পুরোদস্তুর প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত হয়ে যাই। সে বার মোহনবাগান বনাম ইস্টার্ন রেল ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক আমি। ম্যাচটা দেখতে মাঠে গিয়েছি এই আশায় যে, প্রদীপদা গোল করে আমাদের সুবিধা করে দেবেন। খেলা শুরু হল। মোহনবাগানের গোলে প্রদ্যুৎ বর্মন। ইস্টার্ন রেল কিছুতেই গোল করতে পারছে না। হঠাৎ দ্বিতীয়ার্ধে শেষ দিকে বাঁ দিকে একটা বল ধরে গোলার মতো শটে গোল করলেন প্রদীপদা। ইস্টার্ন রেলের গোল দেখে হইহই করতে করতে বাড়ি ফিরেছিলাম।
সত্তর সালে ইস্টবেঙ্গল সদস্য হলাম। এ বার ভক্ত হয়ে গেলাম কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পঁচাত্তরে আমাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের ঐতিহাসিক পাঁচ গোলে জয় বা সত্তর দশকে টানা লিগ জয়— এ সব সাফল্যই কোচ প্রদীপদাকে আমার অন্তরে সোনার সিংহাসন পেতে দিয়েছিল। ভারতীয় ফুটবলে আমার দেখা সেরা কোচ প্রদীপদাই। যেমন প্রখর ফুটবল বুদ্ধি, তেমনই অনুশীলনে অভিনবত্ব। প্রত্যেক ফুটবলারের মধ্যে থেকে কী ভাবে সেরাটা বার করতে হবে, তা ওঁর চেয়ে ভাল কেউ বুঝতেন না।
প্রদীপদার কথা উঠলে সবাই ভোকাল টনিক বলবেন। আমি কিন্তু বলব, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন কলকাতা ময়দানের সেই বিরল ফুটবল কোচ যিনি ‘চচ্চড়ির মশলা দিয়েই বিরিয়ানি’ (প্রদীপদার প্রিয় উক্তি) রাঁধতে পারতেন।
কী রকম? আমি তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা। ফুটবল দল গড়ায় আমার মতামত প্রাধান্য পায়। সে বার আমাদের দল থেকে মোহনবাগান তুলে নিল ভারতের সেরা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়কে। আমি পরদিন অনুশীলনে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছি। প্রদীপদা তা দেখে আমার কাছে এসে বললেন, ‘‘তুই এত মুষড়ে পড়েছিস কেন? অপেক্ষা কর, সুদীপের বিকল্প তুলে আনব।’’ সে বার আমরা স্টপারে সই করিয়েছিলাম অমিত ভদ্রকে। সেই অমিতকেই সে বার সুদীপের জায়গা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলিয়ে দলকে সাফল্য এনে দিলেন প্রদীপদা।
ডুরান্ড কাপের ফাইনাল। ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল বাইরে খেলতে গেলে তখন প্রদীপদা আর আমি হোটেলের এক ঘরে থাকতাম। ফাইনালের সকালে ভোর চারটের সময়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে দিলেন। বিড়বিড় করে বলে চলেছেন, ‘‘ওদের প্রশান্তকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) আমি খেলতে দেব না।’’ ঘুমের মধ্যে কথাটা শুনে বললাম, ‘‘আরে হল কী? ওর খেলা বন্ধ করবেন কী ভাবে?’’ আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বললেন, ‘‘দেখ কাকে দিই প্রশান্তকে আটকানোর দায়িত্ব।’’ চূড়ান্ত দল গড়ার আগে নতুন ছেলে দেবাশিস সরকারকে প্রদীপদা দিলেন প্রশান্তর মতো দুরন্ত ফুটবলারকে আটকানোর ভার। মাঠে নামার আগে দেবাশিসকে প্রথম দু’মিনিট কড়া কথা বললেন, আর পাঁচ মিনিট বুকে জড়িয়ে ধরে বলে দিলেন ওর শক্তি কী আর প্রশান্তর দুর্বলতা কোথায়। এতেই কাজ হল ম্যাজিকের মতো। দেবাশিস সে দিন প্রশান্তকে নড়তে দেয়নি। ট্রফি নিয়ে কলকাতা ফিরেছিলাম।
খেলোয়াড় জীবনে নিজে বড় ফুটবলার ছিলেন। রোম অলিম্পিক্সে ভারতীয় দলের অধিনায়ক। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গোল করেছেন। সেই প্রদীপদা তাঁর সময়ের খেলার গল্প বলতে গেলে সব সময়ে নিজের চেয়েও এগিয়ে রাখতেন চুনীদাকে (গোস্বামী)। এতটাই মহৎ মনের মানুষ ছিলেন তিনি। বলতেন, ‘‘গোঁসাই (চুনীদাকে এই নামেই ডাকতেন) ছিল আলাদা মানের ফুটবলার।’’
দুর্দান্ত রসবোধ। তেমন পাণ্ডিত্য। কোনও দিন হতাশ হতে দেখিনি। এতটাই তাঁর ইতিবাচক প্রাণশক্তি। কিন্তু সেই প্রদীপদাকেও ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম রোভার্স কাপের ফাইনালে। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। ফাইনালে আমাদের বিপক্ষে মোহনবাগান। রেফারি একটা বিতর্কিত পেনাল্টি দিয়ে দিলেন মোহনবাগানকে। যেখান থেকে গোল করে জিতে গেল ওরা। হোটেলে ফিরে ফুটবলারদের বাড়ি ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করে ঘরে ঢুকলাম। দেখি প্রদীপদা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আসেন। বললাম, ‘‘আরে পি কে ব্যানার্জির হল কী?’’ মুখটা তুলে তাকালেন। চোখটা ছলছল করছে। হাত দু’টো চেপে বললেন, ‘‘গড়গড়ি, এই নিয়ে চারটে ট্রফির ফাইনালে উঠে হারলাম। মনটা আজ ভাল নেই রে। আমরা গোল করতে পারব না কেন বল তো?’’ সে দিন ফুটবলারদের কয়েকজনকে ঘরে এনে দেখিয়েছিলাম, ফুটবলের প্রতি ভালবাসা, দায়বদ্ধতা কাকে বলে।
আর ম্যান ম্যানেজমেন্ট? ওতে তো প্রদীপদা একশোয় একশো পাবেন। জানতেন কোন ফুটবলারের কোন জায়গায় আঘাত করলে সে বাঘের মতো জেগে উঠবে। চিমার মতো বোহেমিয়ান, মেজাজি ফুটবলারকেও প্রদীপদা হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন ভালবাসা আর কড়া শাসনের মাধ্যমে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে চিমাকে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়াতেন, তেমনই বকাঝকাও করতেন প্রবল।
প্রদীপদার সঙ্গে শেষ দেখা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালের সময়। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। সেই প্রদীপদা নেই, ভাবলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তবে ওঁর মতো কিংবদন্তির সত্যিই মৃত্যু হয় নাকি?