দক্ষিণ আফ্রিকা নেট। আলোচনায় হাসি-কার্স্টেন। (ডান দিকে) ডোনাল্ডের ক্লাস। ছবি: দেবাশিস সেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাড়িতে সকালে যখন মোবাইলে ধরা হল, তিনি বাচ্চাদের জন্য রুটিতে মাখন লাগিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন। এর পর তাদের গাড়ি চালিয়ে স্কুল পৌঁছবেন। আর পাঁচ জন গেরস্থর মতোই জীবন কাটাচ্ছেন যখন বিশ্বকাপে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ আর মাত্র দু’দিন দূরে!
গত বার ছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় দলের মনোবিদ। তার পর দক্ষিণ আফ্রিকা টিমে গ্যারি কার্স্টেনের সঙ্গে চলে যান। সেখানেই মনোবিদ হিসেবে কাজ করছিলেন। মাস আটেক আগে নতুন কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো তাঁকে ছেঁটে ফেলেন। বিশ্বকাপের আট-ন’মাস আগে থেকে ডে’ভিলিয়ার্সের টিম নতুন মডেলে চলে গিয়েছে। যা বৃহস্পতিবার আরও খোলসা করলেন দক্ষিণ আফ্রিকান চিফ কোচ।
“আমরা চাপে পড়লে নিজেদের স্কিলের ওপরই ভরসা রাখতে চাই। কোনও মনোবিদের টোটকায় নয়। প্লেয়ারের স্কিল যদি ভাল হয়, সে আপনাই জানবে চাপ থেকে কী করে বেরোতে হয়,’’ বললেন রাসেল। যা সাবেকি দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী।
দলগত ভাবে টিমের সঙ্গে মনোবিদ রাখার গুরুত্ব ক্রিকেটবিশ্বে দক্ষিণ আফ্রিকাই বরাবর সবচেয়ে বেশি দিয়ে এসেছে। বাকি বিশ্ব একটা সময় তাদের মনোবিদ-নির্ভরতা দেখে যখন হাসত তখন স্প্রিংবকরা জোরালো ভাবে বলেছে, “অন্য দেশ আমাদের সমস্যা বুঝবে না। আমরা অ্যাপারথাইড অধ্যায় পেরিয়ে এসেছি। আমাদের দেশে প্লেয়ারের মনে অনেক কিছু চাপা যন্ত্রণা থাকে যার জন্য মনোবিদ চাই-ই।”
এ বারের বিশ্বকাপে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা মনোবিদ বিহীন সাপোর্ট স্টাফ প্যানেল নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকটা ব্যাপারে তারা এত স্পেশ্যালাইজেশনে বিশ্বাসী। মোটামুটি একটা প্রতিনিধি দলের মতো সাপোর্ট স্টাফ এনেছে। এক জন হেড কোচ রাসেল। সঙ্গে সহকারী কোচ। এবং প্রাক্তন কোচ কার্স্টেন যিনি নির্দিষ্ট কিছু দিন দলের সঙ্গে থাকবেন। এ ছাড়া অ্যালান ডোনাল্ড-সহ তিন জন বোলিং কোচ। এক জন ফিল্ডিং কোচ, এক জন ফিজিও। এক জন লজিস্টিকস ম্যানেজার। এক জন টিম ম্যানেজার। এক জন মিডিয়া ম্যানেজার। এক জন সিকিউরিটি ম্যানেজার ও এক জন ভিডিও অ্যানালিস্ট। এত লম্বা দলে কোনও মনোবিদ নেই মানে লক্ষ্য খুব পরিষ্কার চোকার বদনাম যারা এত বছর থেকেও তাড়াতে পারেনি। চাপের মুখে মনের জোর আমদানি করাতে পারেনি তাদের প্রথম তাড়াও!
টিম কি তা হলে অটোপাইলট মোডে নিজেরাই বড় সব চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে? যেমন রোববার ইন্ডিয়া ম্যাচ? রাসেল একটা অদ্ভুত উত্তর দিলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিরিজের মধ্যে নাকি নানা ভাবে টিমকে বলা হয়েছে, কালকের ওয়ান ডে-টা এমন ভাবে দেখো যেন বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে নামছ। মাসখানেক আগে পাকিস্তানের সঙ্গে ওয়ান ডে সিরিজের সময় টিম নাকি সেই ভাবেই ভিস্যুয়ালাইজ করেছে।
উত্তরটা আশ্চর্য এ জন্য যে এ ভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করানোটা তো আপটনের টেকনিক। টিম ইন্ডিয়াকে নিয়ে বিশ্বকাপের আগের দেড় বছরে তো তাই করেছিলেন। ফাইনালের ঠিক এক বছর আগে বলেছিলেন, কাল দোসরা এপ্রিল দর্শকঠাসা ওয়াংখেড়েতে তোমরা ফাইনাল খেলছ, এই ভাবে তৈরি হও।
যদি ভিস্যুয়ালাইজ করেই তৈরি করায় তা হলে আর দক্ষিণ আফ্রিকা প্লেয়ারদের স্কিলের ওপর ভরসা রাখল কোথায়? রাসেল ডোমিঙ্গোর কথার মধ্যে বারবারই কন্ট্রাডিকশন ধরা পড়ল। নাকি চল্লিশ বছরের কোচের সব মনের কথা নয়? হয়তো দেশের বোর্ড তাঁকে বাধ্য করেছে এই ভাবে ভাবতে। হয়তো চোকার বদনাম এড়ানোর জন্য তাদের একটা বেড়ে ব্যাটা খুঁজে পাওয়ার দরকার ছিল! মনোবিদ হলেন সেই বেড়ে ব্যাটা যাঁকে সব ব্যাটাকে ছেড়ে ঝুলিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ।
ভারতের সঙ্গে এই ব্যাপারে মিল আছে দক্ষিণ আফ্রিকার। ভারত আর আপটন-উত্তর মনোবিদই রাখেনি। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এতে খুব একটা বিশ্বাসী নন, সিএসকেতেও তাই কোনও মনোবিদ নেই। অস্ট্রেলিয়ায় এ বার টানা ভারত খারাপ করার পর কথা উঠেছিল অতীতে টিমের সঙ্গে কাজ করা স্যান্ডি গর্ডনের পরামর্শ নিলে কেমন হয়? ধোনিরা কোনও তৎপরতাই দেখাননি। তাই বিশ্বকাপে যাদের কাছে তারা ০-৩ পিছিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নামার আগে স্কিলই ভরসা।
এ দিন প্র্যাকটিসে না যাওয়া ভারতীয় দলের কেউ কেউ বোর্ডের কাছে আবেদন করেছিলেন, তাঁদের স্ত্রী/বান্ধবীদের এ বার আসতে দেওয়া হোক। দেশ থেকে এত দিন একা একা থেকে তাঁরা মনোকষ্টে ভুগছেন। বোর্ড রাজি হয়নি। বলেছে, টিম সেমিফাইনালে উঠলে অনুমতি দেব। তত দিন অবধি পুরো মনযোগে খেলে দাও। ক্রিকেটাররা আশা করছেন, শেষ পর্যন্ত ওটা শিথিল হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই অনুমতি পাওয়া যাবে।
পাকিস্তান ম্যাচ এত কর্তৃত্ব নিয়ে জিতে শোনা যাচ্ছে ভারতীয় দলের অভ্যন্তরীন কলকব্জা টানটান করে দিয়েছে। শাস্ত্রী আর ধোনি দু’জনেই ছেলেদের বলেছেন, এই যা ফর্ম্যাট দিনের শেষে ভাল খেলতে হবে তিনটে ম্যাচ। ছেলেরা ওটা কমিয়ে দু’টো করে নিয়েছেন (কোয়ার্টার ফাইনালটা মোটামুটি খেললেও জিতব)। কেউ কেউ টিমের মধ্যে আলোচনা করেছেন, একটা ম্যাচ শুধু ফাটিয়ে খেলতে হবে তা হলেই আমরা ফাইনাল। তার পর তো টপ ফর্মে খেলতে হবে আর মাত্র এক দিন।
এ ভাবে বিশ্বকাপ-চাপকে পাত্তা না দিয়ে সহজ করে ভাবার কৌশলও কি চার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকান মনোবিদের নোটসে ছিল? এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাচ্চাদের টোস্ট খাইয়ে স্কুলে ছেড়ে আসাও হয়ে গিয়েছে প্যাডি আপটনের। ওঁর মোবাইলটা আর এক বার বাজালেই তো হয়!