পঙ্কজ আডবাণী। নিজস্ব চিত্র।
পঙ্কজ আডবাণী। বিলিয়ার্ডস এবং স্নুকার মিলিয়ে ২৩ বারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বর্তমান সময় দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব কলকাতায় এসেছেন বেঙ্গল প্রিমিয়ার লিগ খেলতে। খেলার মাঝেই মুখোমুখি হলেন আনন্দবাজার অনলাইনের।
প্রশ্ন: করোনার পর আবার প্রতিযোগিতা খেলছেন। কতটা বদল হয়েছে?
পঙ্কজ আডবাণী: শুধু খেলা নয় আমাদের জীবনই অনেক বদলে দিয়েছে করোনা। আগে আমরা টাকা, পেশা, নাম, যশ এই সবকে গুরুত্ব দিতাম। কিন্তু করোনার সময় থেকে আমাদের ভাবনা বদলে গিয়েছে। এখন আমাদের সকলের কাছে সবথেকে বেশি গুরুত্ব পায় স্বাস্থ্য। হ্যাঁ কিছু বিধি হয়তো মানতে হচ্ছে। তাতে মূল খেলাটার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতিযোগিতা একই রকম আছে।
প্রশ্ন: ২৩ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও বেঙ্গল প্রিমিয়ার লিগ খেলতে কলকাতায় এলেন কেন?
পঙ্কজ: বেঙ্গল প্রিমিয়ার লিগ বেশ ভাল মানের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব সেরা খেলোয়াড়রাই এখানে এসেছে। যারা উঠতি খেলোয়াড় তারাও এসেছে। অনেক জুনিয়র খেলোয়াড় আছে। স্থানীয়রাও আছে বিভিন্ন দলে। বুঝেই পারছেন সব স্তরের খেলোয়াড়রা এক সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এটা খুব ভাল দিক। লিগ ভিত্তিক প্রতিযোগিতা। দু’জনে খেলতে হয়। খেলার এই ধরনটাও বেশ ভাল। আর কলকাতায় আসতে আমি সব সময় পছন্দ করি। আমার অন্যতম পছন্দের শহর। এখানকার মানুষ খুব ভাল। অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ। সম্মান করেন। তা ছাড়া এখানকার খাবার আমার খুব প্রিয়। দারুণ দারুণ সব পদ খাওয়া যায়।
প্রশ্ন: এখন তো অনেক খেলারই প্রিমিয়ার লিগ হচ্ছে? এগুলো কি আদৌ খেলাগুলোর উন্নতি করছে?
পঙ্কজ: এটা একটা ভাল দিক। দু’তিন বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিলিয়ার্ডস সংস্থা এই প্রতিযোগিতা খুব সুন্দর ভাবে আয়োজন করছে। এই প্রতিযোগিতায় খেলতে ভালই লাগে। ২০১৭ সালে এক বার ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ হয়েছিল। সেখানে বিদেশের বেশ কয়েক জন সেরা খেলোয়াড় এসেছিল। এই ধরনের প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়রা লাভবান হয়। শেখার সুযোগ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: ২৩ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, এই ধারাবাহিকতার রহস্য কী?
পঙ্কজ: (হেসে ফেললেন) কোনও রহস্য নেই। এটা আমার একার কৃতিত্ব নয়। আমার মা, আমার পুরো দলের অনেক অবদান রয়েছে। মা সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। বিলিয়ার্ডস বা স্নুকার ভীষণ মনসংযোগের খেলা। ধৈর্য্য রাখতে হয়। এই খেলাটা অনেকটাই মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করে। খেলায় হার জিত থাকবেই। হারটা যেমন মেনে নিতে হয়, জয়টাও তেমনই সহজ ভাবে নিতে হয়। মানসিক শক্তি বজায় রাখাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমাদের খেলাটায় প্রতিপক্ষকে সরাসরি সামলানোর ব্যাপার নেই। টেনিস বা ক্রিকেটের মতো। পুরো খেলাটাই নির্ভর করে ব্যক্তি খেলোয়াড়ের উপর। আমিই আমার খেলাটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এই খেলাটা আমাকে মানুষ হিসেবেও উন্নতি করতে সাহায্য করেছে। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট, ফেয়ার প্লে এগুলো ভাল মানুষ হতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: ভারতে কিউ স্পোর্টসের পরিকাঠামো বা শেখার সুযোগ কেমন?
পঙ্কজ: বেশ ভাল পরিকাঠামোই রয়েছে। আমাদের দেশে বেশ কয়েক জন দুর্দান্ত কোচ রয়েছেন। মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে একাধিক ভাল কোচ রয়েছেন। কলকাতায় মনোজ কোঠারি, শ্যাম জগদানির মতো কোচরা রয়েছেন। ছোটদের মধ্যে আগ্রহও বেড়েছে। চাইলে আমাদের দেশে বিলিয়ার্ডস বা স্নুকার যে কেউ শিখতে পারে। প্রাথমিক টেকনিকগুলো শেখার জন্য ভাল কোচের অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু যে শিখছে, তাকেও সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমাকেও অনলাইনে সেখানোর জন্য অনেকে অনুরোধ করেন। কিন্তু এখনই কোচিং করার পরিকল্পনা নেই আমার। এখনও খেলছি আমি। ভীষণ ভাবে প্রতিযোগিতামূলক খেলার মধ্যে রয়েছি। এখন চাইলে অনলাইনেও অনেক কিছু শেখা যায়।
প্রশ্ন: যে কেউ চাইলেই কি শিখতে পারবে? বিলিয়ার্ডস বা স্মুকার তো বেশ ব্যয়সাপেক্ষ খেলা?
পঙ্কজ: এই ভুল ধারণাটা প্রায় সকলের মধ্যেই আছে। সবাই ভাবেন এটা বড়লোকদের খেলা। স্নুকার বা বিলিয়ার্ডস কিন্তু একদমই খরচ সাপেক্ষ খেলা নয়। বরং অনেক খেলার থেকেই খরচ কম। বোর্ডের দাম অবশ্য কম করে আড়াই-তিন লক্ষ টাকা। কিন্তু সেটা সাধারণত খেলোয়াড়দের কিনতে হয় না। ক্লাবেই থাকে বোর্ড। ক্লাবগুলো খুব কম টাকায় আরও অনেক সুবিধা দেয়। কিন্তু একটা ভাল র্যাকেট বা ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনতে যা খরচ হয় তা আমাদের হয় না। এখনও মনে আছে প্রথম কিউ স্টিক কিনেছিলাম ৫০০ টাকা দিয়ে। আমার এই টুকুই বিনিয়োগ ছিল। বাড়ির কাছে একটা ক্লাবে খেলা শিখতাম। আমি এবং আরও অনেকেই তো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই উঠে এসেছি।
প্রশ্ন: ক্রিকেট যেমন জনপ্রিয় হয়েছে বিলিয়ার্ডস বা স্নুকার তেমন নয়? খেলাটার আরও প্রচারের কি দরকার আছে?
পঙ্কজ: দেখুন আমি খেলোয়াড়। খেলাটাই আমার কাজ। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন জাতীয় সংস্থার কর্তারা। এটা ওঁদের বিষয়। আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে, আমাদের খেলাটাও এগোচ্ছে।
প্রশ্ন: ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন, পদ্মভূযণের মতো সম্মান পেয়েছেন? বিলিয়ার্ডসের প্রসার বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য সরকারের কি আরও সক্রিয় ভুমিকা নেওয়া উচিত?
পঙ্কজ: আমাদের এত বড় দেশ। বিশাল জনসংখ্যা। প্রতিভার কোনও অভাব নেই। এটা ঠিক, সব খেলারই নিজস্ব পরিচিতি প্রয়োজন। সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ছোটবেলায় আর পাঁচটা ছেলের মতো আমিও ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেবল টেনিস সবই খেলতাম। বছর দশেক বয়স থেকে বুঝতে পারি এই খেলাটাই আমার সবথেকে বেশি ভাল লাগছে। তখন থেকে শুধু বিলিয়ার্ডস খেলতে শুরু করি। কার কোন খেলায় বা কোন বিষয়ে আগ্রহ সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: তা হলে ১৩-১৪ বছর বয়সে খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা কেন ভেবেছিলেন?
পঙ্কজ: দেখুন সবার জীবনেই কঠিন সময় আসে। ওই সময়গুলো কোনও কিছুই ঠিক মতো হয় না। অনেক কিছুই ভাল লাগে না। আমারও তেমনই হয়েছিল। কিছুটা হতাশা থেকেই খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। পরে বুঝেছি, তখন হাল ছাড়িনি বলেই আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি। চেস্টা করে যাওয়াটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কী?
পঙ্কজ: খেলাটাকে ভালবাসতে হবে। উপভোগ করতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। অন্য কোনও বিকল্প নেই। অর্থ, খ্যাতি, যশ লক্ষ্য থাকলে কিন্তু হবে না। এক এবং একমাত্র লক্ষ্য রাখতে হবে খেলাটা খুব ভাল করে শেখা এবং সেটার যতটা সম্ভব সঠিক প্রয়োগ করা। খেলায় ভুল হবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই ভুলগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। শুধরে নিতে হবে।